সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আমাদের মন্তব্য

প্রথমেই সবার উদ্দেশ্যে আমার একটি প্রশ্ন থাকবে। সেটা হলো, এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কাকে সবথেকে বেশি গালাগালি শুনতে হয়? উত্তরটা আপনারা নিজেরাই খুঁজে বের করবেন।

আমাদের মানবকূলের শ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আল্লাহ তাঁর অন্তর থেকে হিংসা,ঘৃণা,রাগ তুলে নিয়েছিলেন। যারা তাঁর জীবনী পড়েছেন তারা জানেন যে তিনি সারাজীবন কি কষ্টটাই না করেছেন আর কতই না কষ্ট পেয়েছেন মানুষের কাছ থেকে। তারপরও তিনি কাউকে কিছু বলেন নি। যার অন্তরে আল্লাহ এত সহ্য এবং ধৈর্য ক্ষমতা দিয়েছিলেন তারপরও মানুষের কটূক্তিতে মাঝে মাঝে তিনি কাঁদতেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন।

তাঁর মতো মানুষ যদি অন্যদের কটূক্তিতে কাঁদতে পারেন তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ,আমরা ছোট-বড় অনেক কষ্টেই কাঁদতে পারি। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় যে কষ্টের কারণে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায়।

এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথায় আসি। আমি খুব আশ্চার্য হয়ে লক্ষ্য করেছি মানুষের মন্তব্যগুলো কখনোও কখনোও কি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। যারা অন্যদের কথা না বুঝেই কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ করেন তারা একবারও ভাবেন না যে তার একটা বাজে মন্তব্য সামনের মানুষটাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিতে পারে। যার পোস্টে সে না বুঝেই কমেন্ট করেছে তাকে হয়তো সে চেনেনা,জানেও না যে সে কি বলতে চাচ্ছে এবং বোঝার চেষ্টা না করেই বাজে মন্তব্য করে বসেছে। যে বাজে মন্তব্য করেছে তার এতটুকু বোধ নেই যে,তার একটা বাজে মন্তব্যই তাকে মানুষের কাছে ছোট করে দিচ্ছে। কাউকে আক্রমণ করে হয়তো সাময়িক পৈশাচিক আনন্দ লাভ করা যায় কিন্তু এটাও মনে রাখবেন যে একদিন তা দশগুণ হয়ে আপনার কাছে ফেরত আসবেই। বিষয়টা এমন যে, ঘাড়ের কাছে অদৃশ্য একটা নেকড়ে সব সময় দাঁত-নখ বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তা দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু সুযোগ বুঝে একদিন ঠিকই তা আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ক্ষমা প্রসঙ্গে ইবাদত দুইরকমের আছে।

১. হাক্কুলাহ (আল্লাহর প্রতি হক)
২. হাক্কুল ইবাদ (বান্দার প্রতি হক)
হাক্কুলাহ এমন এক ক্ষমা যা আল্লাহ তায়ালা শিরক বাদে অন্য সব অপরাধ যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় তা ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করবেন। যেমন: নামাজ, রোযা, হজ্জ, যাকাত এবং তৎসংগে আর যা কিছু আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।

 

আরো পড়ুন:
“বেঁচে থাকাটাই এই বছরের বড় চ্যালেঞ্জ!!”- তাতে আমার কি?
ওগো আজ যাসনে তোরা ঘরের বাহিরে
প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশের ডাক্তার

আর, হাক্কুল ইবাদ- এই হক নষ্ট করলে সচরাচর আল্লাহ ক্ষমা নিজ হাতে রাখেননি। কাউকে ধোকা দেওয়া, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করা, কারো মনে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো থেকে ক্ষমা পাওয়া খুব জটিল একটি প্রক্রিয়া।

নিজে দেখা একটি উদাহরণ দেই। আমার চেনা একজনের মুখের ভাষা এত খারাপ ছিল যে,সবাই তাকে ভয় পেত যে কখন গালাগালি করে। তার মৃত্যুর সময় তাকে দেখতে গিয়ে দেখলাম তার পুরো মুখ অজানা এক অ্যালার্জিতে ভরে গেছে,চোখ ঢেকে গিয়েছে। এই মানুষটাকে দেখে কারও বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগেনি বরং সবাই মনে মনে খুশি হচ্ছিলো।

রেবেকা শফিকে আমরা অনেকেই চিনি। উনি সম্ভবত ১৯৯৪ সালে বিটিভিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। উনার কথার মুগ্ধতায় আমি যখন বিভোর তখন দেখলাম একজন মন্তব্য করেছেন,” এই মেয়ের চেহারা ভালো না,বিয়ে হবে না।” উনার অসম্ভব সুন্দর কথাগুলো লোকটার কানে গেল না,লোকটা পড়ে থাকলেন বিয়ে হবে না নিয়ে। অথচ রেবেকা শফি এখন কোথায় আমরা তা সবাই জানি। উনি এখন আমেরিকায় বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে গবেষণায় মগ্ন এবং একজন দেবতুল্য চেহারা এবং মনের স্বামীর সাথে বসবাস করছেন। হাজার জনের বাজে মন্তব্যেও কিন্তু উনার যোগ্যতার কোথাও ছেদ হয়নি। উনি সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে চেহারা নয়,জ্ঞানের আগুনটাই প্রধান যা তিনি জ্বালাতে পেরেছেন।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বাজে মন্তব্য করে থাকে কারণ তারা জ্ঞানের সেই মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি যেখানে পৌঁছালে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে সম্মান বোধ করবে- যাকে বলে নিজের প্রতি সম্মান।

নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও এটি একটি অসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিষয়টা এমন যে দুধের বাচ্চার কাছে পোলাও-কোর্মা দেওয়া হয়েছে যা সে খাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেনি।

আমরা কেউ পরিশুদ্ধ মানুষ নই কিন্তু ইতিবাচক চিন্তা করতে তো সমস্যা নেই। ভুল করে ভুল মানুষকে ভালো ভাবতে দোষ নেই। কিন্তু ভুল করে ভালো মানুষকে খারাপ ভাবায় দোষ আছে।

আমরা ভালো কাজের প্রশংসা না করতে পারি অন্তঃত চুপ করে থাকার ধৈর্য ধারণ করতে শিখি। নাহলে এই সমাজের মানুষ ভালো কিছু করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আপনাদের খারাপ মন্তব্য দিয়ে ভালো মানুষগুলোর মানসিক শক্তি নষ্ট করবেন না দয়া করে তাহলে- দুঃসময়ে আমরা কাদের শরণাপন্ন হবো? জানি আল্লাহ সবকিছুর মালিক কিন্তু তিনি মাধ্যম দিয়ে তার শক্তি প্রদর্শন করেন- নাহলে তাঁকে যুগে যুগে এতো নবী-রাসুলদের পৃথিবীতে পাঠাতে হতো না।

লেখক- এলিজা শরমিন
লেখক ও চিত্রশিল্পী