প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশের ডাক্তার

একজন ডাক্তার ঈশ্বরতূল্য প্রায়। কারণ যারা আস্তিক, তারা প্রথমত; বিশ্বাস ও ভরসা রাখেন স্রষ্টার প্রতি; এবং দ্বিতীয়ত; ভরসা রাখেন ডাক্তারের প্রতি নিজের শরীর ও মনের সুস্বাস্থ্যের জন্য। একথা বলার অবকাশ নেই যে, রাস্তার উন্নয়ন, মহাকাশ যাত্রা, ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি, এসবের চেয়েও কোটি কোটি গুণ মূল্যবান হচ্ছে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা। যদি আমি সুস্থ্যই না থাকি, তবে কোটি কোটি টাকা আমার থাকলেও, তা মূল্যহীন। বরং পান্তাভাত খাওয়াও অনেক সুখের, অনেক তৃপ্তির যদি স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এটা দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম থাকলেও, আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল নেই। উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাসীনরা যেকোন রোগেই বাইরে যান চিকিৎসা করাতে। যাদের অত টাকা নেই, তারা কী করবে? তাদেরওতো বাঁচতে ইচ্ছে করে। এ সুন্দর পৃথিবীতে আরও কিছুকাল থেকে যেতে ইচ্ছে করে। টাকা নেই বলে কি স্বপ্নও মরে যাবে, নি:শ্বেস হয়ে যাবে? খাদ্যের ভেজালের ধারাবাহিকতা পুরো জাতিকে একটি পঙ্গু জাতিতে পরিণত করছে। এসব দেখার দ্বায়িত্ব কার?

ডাক্তারগণ যারা লোভী, যারা শুধু টাকা বানাতে চান, তাদের গ্রাসের থাবায় মুখ থুবড়ে পড়েছে এ দেশের এ জাতির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে অর্থ উপার্জন করে চলেছে। সরকারি অনেক ডাক্তার চেম্বারে ঠিকমতো না বসে ব্যক্তিগতভাবে ক্লিনিকে রোগী দেখেন। নামমাত্র হাসপাতালে যেয়ে চাকরী বাঁচিয়ে চলেন। আর একটু ভেতরের দিকে যে সব উপজেলা আছে, সেখানে সরকারি হাসপাতালে সরকারি ডাক্তার পাওয়া রীতিমতো ভগ্যের ব্যাপার!

বেসরকারি ক্লিনিকে কীভাবে সেবা দিচ্ছেন ডাক্তারগণ? ভিজিট মফস্বল শহরে ৬০০/৮০০ টাকা। এরপর যে রিপোর্ট করালেই যথেষ্ট, তার সাথে আরও কিছু জুড়ে দেন।কারণ রিপোর্ট থেকে কমিশন ৩০%-৪০% পান। কোন কোন ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ ডায়াগনস্টিক থেকেই রির্পোট করাতে বলেন। হয়ত সেখানে কমিশন আরও বেশী। অনেকে আবার রির্পোট দেখানোর সময় পুণরায় টাকা নেন। মোটামুটি ৫০০০ টাকার কম নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া অর্থহীন।

সারা দেশে যত মানুষ আছে, প্রায় সবাই রোগী। একজন ডাক্তারের ওপর এত চাপ! কেউ কেউ দিনে ২০০(+-) রোগী দেখেন।  চাকরী করে একদিনে এত রোগী কি দেখা সম্ভব? একজন রোগীর ব্যাপারে ১/২ মিনিট সময় দেন। রোগ শুনতে শুনতে প্রেসক্রিপশনে অর্ধেক ঔষধের নাম লেখা হয়ে যায়। আমাদের দেশে কি ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় না?

আমার আব্বাকে একবার একজন স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার রোগের কথা শুনে ঔষধের নাম লিখে দিলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে এক কোম্পানির একজন রিপ্রেজেনটেটিভ এসে ডাক্তারকে বলল, ‘ওনাকে আমাদের কোম্পানির একটা ভিটামিন লিখে দেন।’ ডাক্তার আবার পেসক্রিপশন নিয়ে তাই করলেন। আমরা অবাক হলাম! ওইসব কোম্পানির কাছ থেকে ডাক্তাররা অনেক উপহার পান। আমার ছেলেকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তখন রাত। প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। ডিউটি ডাক্তারকে বলার পর, সে পেসক্রিপশন লিখে দিল। আমরা ভর্তি হতে চাইলে ভর্তি করে নিল। আমার ছেলের কাছেই সে একবারও এলোনা। সারারাত-সারাদিন ছেলেটা ব্যথায় ছটফট করল। পরে হাসপাতালের বিশেষ একজনকে ধরে এক ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরে পরদিন দুপুরে তাকে ছেলের কাছে আনতে পারলাম। তিনি দেখে বললেন, ‘সম্ভবত এপেণ্ডিসাইট। বিকালে আমার চেম্বারে নিয়ে আসেন।’ কী আর করার, তাই করতে হলো। আমি নিজে একবার চোখ দেখাতে সদর হাসপাতালে গেলাম। বছর দশেক আগের ঘটনা। পাঁচ টাকার টিকিট কেটে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। ১জন সিনিয়র ও ২ জন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন। চোখ কোন রকম দেখেই একটা পাওয়ার দিয়ে, ঠিক মতো দেখতে পারছি কিনা জিজ্ঞেস করার আগেই চশমা নিতে হবে বলে পাওয়ার দিয়ে দিলেন; আর বললেন, ‘ডান চোখ ব্লাইন্ড।’ আমি বুঝলামই না কী দেখল আর কী বলল? সে যে পাওয়ার লিখেছে, তা দিয়ে আমি ভালভাবে দেখতে পারবো কিনা সন্দেহে পরে অন্য ক্লিনিকে যেয়ে অন্য ডাক্তার দেখিয়ে চশমা নিলাম। দশ বছর পার হয়ে গেছে, এখনও আল্লাহর রহমতে ব্লাইন্ড হইনি। এই হলো অধিকাংশ সরকারি ডাক্তারদের সেবা।

আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার রোগী পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্য দেশে যায় চিকিৎসার জন্য্। এটা কি প্রমাণ করেনা যে, আমদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা অনেক কম। আমাদের দেশের ডাক্তারদের ব্রেন কি অন্য দেশের ডাক্তারদের থেকে কম, তা কিন্তু নয়। মূল পার্থক্য হচ্ছে সেবাদান প্রক্রিয়ায়। ডাক্তার যদি রোগীর সাথে ২ মিনিট ভালভাবে কথা বলে, তাহলে রোগীর অর্ধেক রোগ এমনিতেই সেরে যায়।

তারপর রয়েছে ডায়াগনস্টিকে হাজারও সমস্যা। সম্প্রতি তালাশ প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, একই ব্যক্তি একই সময়ে ৩টি ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষা করানোর পর ফলাফল এসেছে ৩ জায়গার রিপোর্ট ৩ প্রকার। যারা এসব পরীক্ষা করে, তারা আয়া-বুয়া শ্রেণির। অথচ এই পরীক্ষাটাই ডাক্তারদের করা উচিত। কারণ এর ফলাফলের ওপরই রোগীর সুস্থ হওয়া নির্ভর করে। এসব দেখার দায়িত্ব কার? সব ধরণের মন্ত্রণালয় রয়েছে এদেশে। তাহলে তাদের কাজ কী? এদেশে জন্মে আমরা কত অসহায়! নির্ভেজাল খাবারের অভাব, ঔষধে ভেজাল, ভুয়া ডাক্তারও রয়েছে প্রচুর। রোগী নিয়ে রোগ নিয়ে অন্য ডাক্তারদের ছিনিমিনি খেলা! ডাক্তারি পেশাকে টাকা বানানোর ব্যবসায় পরিণত করা, সত্যিই খুব দুঃখজনক। এদেশে জন্মে আমরা সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে কার কাছে যাবো?

সম্প্রতি করোনা ‍যুদ্ধে এদেশের অধিকাংশ ডাক্তার লুকিয়েছেন। এটা শুধু দুঃখজনকই নয়, লজ্জাকর এবং প্রচণ্ড ধীক্কারের। যেখানে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এ অবস্থায় চিকিৎসা পেশায় ফেরেন, যেখানে অন্য আরেকটি দেশের ফার্স্ট লেডি চিকিৎসা করছেন, এ দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন, যারা অবসরে গিয়েছিলেন, তারা এ দুর্যোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের সেবাই ফিরে এসেছেন, আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিক নির্দেশনা দেবার জন্য বার বার মিটিং করছেন, সেখানে আমাদের দেশের ডাক্তাররা বলেন, ‘আমাদেরওতো পরিবার আছে, আমরাওতো কারো না কারো ভাই-বোন, মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি।’ এই বলে তারা পালালেন। তাহলে অন্য দেশে যারা এ দুর্যোগ মোকাবেলায় এলেন, তাদের কি ওসব নেই? তারা কি অবিবাহিত-এতিম? ভাবতে লজ্জা লাগে, ঘৃণা হয়। হ্যাঁ-একথা সত্য যে, ডাক্তারদের নিরাপত্তা পোশাক আরও আগে সরবরাহ করা প্রয়োজন ছিল। এই এক কারণে অধিকাংশ ডাক্তার অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেলেন? একজন ডাক্তার কি ১টি পিপিই ক্রয় করার সামর্থ্য রাখেন না? সাধারণ রোগীরা ক্লিনিকের পর ক্লিনিকে যেয়ে ডাক্তার দেখাতে না পেরে অনেকে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। সাধারণ রোগীরা, প্রেগন্যান্ট রোগীরা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ডাক্তার হিসেবে আপনার কি সামান্যতম লজ্জা লাগে না? কয়শ বছর বেঁচে থাকতে চান? এই সময়ে যে সকল পুলিশ, রাব, সেনাবাহিনীর সদস্য, নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দ, নার্সগণ রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করছেন, যে সব ব্যাংকার নিরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, যে সব সাংবাদিক মাঠে রয়েছেন, যে সব স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণ পৌঁছানোর কাজে সহযোগিতা করছেন, তাহলে তাদের কি পরিবারের কেউ নেয়? দেশে যুদ্ধ বাধলে কি সৈন্যরা পালিয়ে যাবে এই বলে যে, ‘আমরা কোন না কোন পরিবারের সন্তান। আমাদের কিছু হলে ওদের কী হবে?’ আপনাদের জন্য লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। আপনারা ডাক্তার, আপনারা ভগবান তূল্য!

এ মহাদুর্যোগেও যে সকল মুষ্টিমেয় ডাক্তার অনেক চাপ সহ্য করে রোগী দেখছেন, তারা মানুষরূপী ভগবান। তাদের ইহকাল অবশ্যই শান্তির হবে। কারণ তাদের আত্মায় যে ফুল ফুটবে, তার ঘ্রাণ তাদের সুখী করবে। আর পরকালেও তারা অবশ্যই শান্তিতে থাকবেন। এই ডাক্তারদের প্রতি মেহনতি কোটি কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সকলেই সুখী হোন। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। সকলকে ধন্যবাদ।

(এই লেখাটি বাংলাদেশের সকল ডাক্তারের জন্য প্রযোজ্য নয়, কিছু সংখ্যক ডাক্তারের জন্য প্রচণ্ডভাবে প্রযোজ্য।)

লেখক- শাহ‌রিয়ার সোহেল
কবি ও প্রাবন্ধিক