আমরা তার অপেক্ষায় থাকব….

কয়েকদিন আগে শেষ হয়েছে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস।এখন শুধু পরীক্ষা বাকি। স্নাতক জীবনের শেষ ক্লাস স্মরণীয় করে রাখতে তারা নানা আয়োজন করে। এমনকি বড় ভাইয়া- আপুদের শেষ ক্লাসের দিনে ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরের স্মৃতি নিয়ে এমনই এক সারসংক্ষেপ লিখেছেন যবিপ্রবির ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র শরীফুজ্জামান সজল।

সময়টা ফেব্রুয়ারি,২০১৬।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ভবনের এক তলার একটা রুমে, প্রথম বর্ষের কিছু ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর এটাই তাদের প্রথম ক্লাস। নতুন পরিবেশ আর ঘরভর্তি অপরিচিত সব সহপাঠীদের সাথে সবাই কেমন যেন একটা জড়সড় ভঙ্গিতে বসে আছে…..কেউ কেউ এদিক সেদিক চাইছে…..সহপাঠীদের চোখে চোখ পড়লে আড়ষ্ট হাসিও দিচ্ছে….। এমনভ
ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ক্লাসে একজন শিক্ষক গুরুগম্ভীর মুখে প্রবেশ করলেন।তিনি জানতে চাইলেন সবাই ইংরেজী বিভাগের ছাত্র কিনা।সবাই হ্যাঁ-সূচকভাবে মাথা নাড়াতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
“বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিন কেমন লাগছে?”
শিক্ষকের গুরুগম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছাত্ররা বুঝে উঠতে পারছিল না কি বলা উচিত হবে, উলটাপালটা উত্তর দিয়ে এমন ‘সিরিয়াস’ টাইপের শিক্ষকের রোষানলে পড়া উচিত হবেনা ভেবেই বোধহয় পুরো ক্লাস চুপ করেই রইল।শুকনো মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর শিক্ষক হঠাৎই হেসে ফেললেন।তার হাসিতে ক্লাসের থমথমে ভাবটা নিমেষেই কেটে গেল!
হাসতে হাসতে শিক্ষক বললেন,
“বলতে পারছ না? লিখতে পারবা? আচ্ছা খাতায় লেখ ত কার কেমন লাগছে।জানালা দিয়ে বাইরে দেখো,তোমার সহপাঠীদের দেখো….এবার কার কেমন অনুভূতি হচ্ছে খাতায় লিখে ফেল ত দেখি..!”

নিষ্প্রাণ থমথমে ক্লাসের মধ্যে হঠাৎই যেন প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল।ক্লাসের সবাই খাতা-কলম বের করে লেখা শুরু করল।তাদের দৃষ্টি কখনো বাইরের শিশিরভেজা পাতাগুলোর দিকে,কখনো বা পাশের সহপাঠীর কৌতূহলী মুখের দিকে…..।শিক্ষক সারা ক্লাস ঘুরে কিছু খাতা দেখলেন।অনেককেই বাহবা দিলেন।তারপর ক্লাসের সামনে থাকা ডায়াসে দাঁড়িয়ে বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা বড় অংশ হচ্ছে তোমার সহপাঠীরা, তোমার বন্ধুরা।তোমরা কি জানো, আগামী চার বছর তোমরা সবাই একটা পরিবারের মত?”
কথাটা শুনে প্রত্যেকের মধ্যে সেদিন একটা উপলব্ধি জন্ম নিয়েছিল।আমি জানি কারণ,বছর চারেক আগে আব্দুল হালিম স্যারের সেই ক্লাসে আমিও ছিলাম।প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার অভিজ্ঞতা নিয়ে কে কি লিখেছিল তা বলতে পারব না,তবে এটুকু জানি সেদিন সবাই মনে মনে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল তাদের নতুন পরিবারকে জানার জন্য।আজ চার বছর পর সেই পরিবার নিয়ে দুই একটা কথা না বললেই নয়।

চার বছর সময়টা আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা কম সময় নয়।তবে যবিপ্রবির ছবির মত সাজানো ক্যাম্পাসে ইংরেজী বিভাগের সুশীতল ছায়ায় বসে সে সময়টা কখন যে পার হয়ে গেছে – তা টেরই পাইনি!!

এই ত সেদিন ফার্স্ট ইয়ারে হালিম স্যার, এডগার এলান পোর ‘ব্ল্যাক ক্যাট’ পড়ালেন! এক অর্ধ উন্মাদ খুনীর রোমহষর্ক কাহিনী শুনে বিহবল হয়ে গেলাম সবাই।এরই মধ্যে চার বছর হয়ে গেল!!! এই ত সেদিন ফারজানা ম্যাম ‘ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস’ পড়াচ্ছিলেন…..চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম এক ছোট্ট ইউরোপীয়ান গোষ্ঠী কিভাবে ধীরে ধীরে অর্ধেক পৃথিবীকে এক পতাকার নিচে এনে ফেলছে…! আর এই ত, কিছুদিন আগেই ওয়ালিদ স্যারের কন্ঠে ট্রোজান যুদ্ধের দামামা শুনতে পাচ্ছিলাম।ক্যালেন্ডার বলছে দেড় বছর হয়ে গেছে সেদিনের ক্লাসের পর, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব! আমি ত সন্তানহারা রাজা প্রায়ামের কান্না আজও শুনতে পাই, চমকে উঠি দেবরাজ জিউসের গর্জনে!!! ক্যালেন্ডার আজ এও বলছে সেদিন থেকে দুই বছর হয়ে গেছে যেদিন ফারহানা ম্যাম ‘স্যামসন এগোনিস্টেস’ পড়ালেন! বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার, স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় শত্রুর কাছে বন্দী এক অন্ধ মহাবীরের আর্তনাদ এতদিন পরও আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আচ্ছা,গ্রীষ্মের সেই উত্তপ্ত দুপুর থেকে আজ ক’দিন হল যখন তন্ময় স্যার ডুবন্ত এক নাবিকের স্মৃতিচারণ করছিলেন! সেও বছর খানেক! স্মৃতির পাতাগুলো বড় একগুয়ে, বয়সটা স্বীকার করা এদের ধাতে নেই।শারমিন ম্যামের আঁকা ইস্তানবুল শহরের যে ছবিটা আমার মাথায় আছে তার বয়সও ডায়রী বলছে বছর খানেক হবে,কিন্তু আদৌ তা বিশ্বাস হয়না।এমন হাজার ছবি গত চার বছরে মনে জমা হয়ে আছে,যেমনটি আছে ‘বৃষ্টিস্নাত কাব্যিক আবহাওয়ার মধ্যে সাহিত্যের ছাত্রদের ক্লাস করা উচিত কিনা’ প্রশ্নের উত্তরে তানজীর স্যারের দেয়া উত্তরটা।

ভার্সিটি লাইফের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে আজ বড়ই হিমশিম খাচ্ছি,আর সেগুলোকে শব্দে রূপ দেয়া ত আরো সমস্যার ব্যাপার!!কোন কোন স্মৃতি অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি এনে দিচ্ছে, কোনটা আবার চোখের পাতাকে আর্দ্র করে তুলছে।
আরো পড়ুন:

পূর্বাশা পরিবহন থেকে ফেন্সিডিলসহ এক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার
পুলিশের কথিত সোর্স শরিফকে দুই মাস কারাদণ্ড
ভূল চিকিৎসায় প্রসূতি রোগির মৃত্যু ডাঃ সুমনুল হকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা

কুষ্টিয়াতে গিয়ে প্রবল ঝড়ের মধ্যে কিভাবে পিকনিক হল, সুন্দরবনে কম্পমান ট্রলারে ছবি তুলতে গিয়ে কে পড়ে যাচ্ছিল,শর্ট ফিল্ম তৈরী করার সময় বন্দুকের নল একদিকে আর গুলি কেন গেল আরেকদিকে – এসব ঘটনাকে ভাষায় রূপ দিতে গেলে আজ কথা বহু বেড়ে যাবে।তাছাড়া লিখতে গেলে আরো লিখতে হবে আমাদের ব্যাচের সেই দূর্লভ বিদ্যার কথা যার মাধ্যমে সারা সেমিস্টার অসুস্থতার জন্য ক্লাসে না এসে, শুধু খেলার দিন সুস্থ হয়ে ক্যাম্পাসে খেলা করে পরদিন থেকে আবার অসুস্থ হয়ে পড়া যায়
কিংবা আমাদের সেইসব ‘পরীক্ষা পেছানো’ অজুহাতের কথা যা শুনে শিক্ষকেরা ভার্সিটিতে বেতের ব্যবহার না থাকায় আফসোস করেন!

যাইহোক,বলা শুরু করলে সারারাত কাবার হয়ে যাবে।তারপরেও অনেক গল্প বাকি থেকে যাবে…… বাকি থেকে যাবে,ডিপার্টেমেন্টের অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সারারাত পরিশ্রম করা মেয়েগুলোর গল্প!! বাকি থেকে যাবে পরীক্ষার সময় এক বন্ধু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর চিন্তিত আর ব্যস্ত মুখগুলোর গল্প! বাকি থেকে যাবে এক বন্ধুর জরুরী প্রয়োজনে, পঞ্চাশ টাকার শেষ নোটটা বিনা চিন্তায় বের করে দেয়া মানিব্যাগটার গল্প!!!!
আজ রাতে একা বসে এসব কথা ভাবতে কেমন যেন অদ্ভূত লাগছে! কিভাবে এতসব মুহুর্ত পার করে দিলাম এত ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে!!!

‘English 3rd Batch’ এর অনেককেই কয়েক মাস পর থেকে আর হয়তো পাব না,তবে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি এই চার বছরের জার্নিটা সবার মনের এককোণে খোদাই করা থাকবে সারাজীবন।আর তাই,শেষ ক্লাসের দিনটাতে সবার মুখে আনন্দ ছিল, ছিল উচ্ছ্বাস।এদিনের আড্ডাবাজি, একে অপরের টিশার্টে কয়েক লাইন লেখা বা কেক কাটা নয়, গত চার বছরের রঙিন স্মৃতিই আমাদের অনার্স লাইফের শেষ দিনটাকে করে রাখবে অমলিন।

জুনিয়র চতুর্থ ব্যাচকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি ছোট করব না।আমাদের সব বিশেষ দিনের সাথে ওরা মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে,আর তাই মনে হয় ক্লাস সাসপেনশনের শেষ সারপ্রাইজটা ওরাই দিল!ভার্সিটি লাইফের এমন সব ছোট ভাইবোনের জন্য আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

পরিশেষে, একটা কথাই বলব।শীতের এক মিষ্টি সকালে হালিম স্যারের ক্লাস দিয়ে অনার্স শুরু করেছিলাম।গতকাল, ক্লাস সাসপেনসনের পর বিকাল সাড়ে পাঁচটাতে যখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল তখন ওইদিনের কথাটাই মনে পড়ছিল বেশী করে।বিদঘুটে রঙে রাঙা টি শার্ট পরা ক্লান্ত ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎই এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছিল ডুবন্ত সূর্য দেখে।তবে তা ক্ষণিকের জন্য।সূর্য যেমন অস্ত যায়,তেমনি পরদিন নতুন এক যাত্রা শুরুর জন্য পূর্ণদ্যোমে ফিরেও আসে..!
আমি তার অপেক্ষায় থাকব….।
আমরা তার অপেক্ষায় থাকব….

লেখক- শরীফুজ্জামান সজল
শিক্ষার্থী, যবিপ্রবি, চতুর্থ বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ।

অক্টোবর ২৩, ২০১৯ at ১৩:৪৫:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/শস/তআ