ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফেরানোর উপায় কী

কোভিডের ধাক্কায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আগামী রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে ঝাড়মোছ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করার কাজ চলছে। এমনকি সপ্তাহের কোন দিন কোন শ্রেণির ক্লাস হবে তাও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্কুল-কলেজ খুললে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে না, কেন ফিরবে না এবং তাদের ফেরানোর উপায় নিয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা নেই।

সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলেছে, স্কুল খোলার পর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না ফেরা শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাজে লাগিয়ে সরকার চাইলে অনায়াসেই এই তালিকা তৈরি করতে পারে। তারা বলছেন, স্কুল-কলেজে আপাতত বিল্ডিংয়ের দরকার নেই। কারণ পর্যাপ্ত বিল্ডিং নির্মাণ হয়েছে। বিল্ডিংয়ের টাকা দিয়ে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ঝরে পড়া দ্রুত কমিয়ে আনাসহ সব শিক্ষার্থী যেন অষ্টম শ্রেণি শেষ করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোভিডের কারণে বাবা-মায়ের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে কাউকে কাউকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কেউ যাচ্ছে কলকারখানায়, কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। এছাড়া দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের কারণেও লেখাপড়া ছেড়ে ঘোরাঘুরি-খেলাধুলা ও আড্ডায় মেতেছে অনেক শিশু-কিশোর। এই পরিস্থিতিতে মহামারি শেষে স্কুল খুললে বাংলাদেশে কতসংখ্যক শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেই পরিসংখ্যান এখনো আসেনি। পরিস্থিতির কারণে এখন সবাই স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছেন। কিন্তু যারা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে না তাদের নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। অথচ বিনামূল্যে পাঠ্যবই, উপবৃত্তিসহ সরকারের নানা উদ্যোগে সাফল্য পেলেও করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সেই অর্জন এখন হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) রতন চন্দ্র পণ্ডিত ভোরের কাগজকে বলেন, কোভিডের ধাক্কায় বহু শিক্ষার্থী আর ক্লাসে ফিরবে না এ রকম কিছু কথা আমাদের কাছেও এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্কুল না খুললে আমরা এ বিষয়টি বুঝব কী করে? কাজেই বিষয়টি সত্যি সত্যি ঘটছে কিনা তা আমরা স্কুল খুললেই টের পেয়ে যাব। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরবে না তা আমরা এখনো জানি না। স্কুল খোলার পর যদি দেখা যায় শিক্ষার্থী বেশি মাত্রায় অনুপস্থিত রয়েছে, তখনই এর কারণ খোঁজা হবে। তারপরেই আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে এটা ঠিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য কোনো শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সরে না যায় সেজন্য প্রধান শিক্ষকদের নেতৃত্বে শিক্ষকমণ্ডলীদের ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মহামারির ধাক্কায় যেসব শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে ফেরা হবে না, তাদের মধ্যে হবিগঞ্জের বাহুবলের দুজন সালমা, লাকি। পঞ্চম ও সপ্তম শ্রেণি পড়–য়া ওই শিক্ষার্থীর বাবার দাবি মেয়ে বড় হয়েছে। স্কুলও বন্ধ। কবে খুলবে তার ঠিক নেই। এজন্য বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। নরসিংদীর বেলাব উপজেলার লক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই ঢাকার একটি ব্যাগ তৈরির কারখানা থেকে চাকরি হারান। কিছু দিনের মধ্যেই পাঁচ সদস্যের এই পরিবারে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় তাতে হোঁচট খায় বড় মেয়েকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন। ওই শিক্ষার্থীর মা হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমরারও ইচ্ছা আছিল মাইয়ারে ডাক্তার-উকিল বানানোর। কিন্তু কী করুম, আমরা গরিব মানুষ। মেয়ের বাপের চাকরি যাওয়ার পর কোনো দিশা না দেইখ্যা তারে বিয়া দিয়া দিছি।’

বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মে মাসে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত যে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, সেখানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারির কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর হয়তো আর ক্লাসে ফেরা হবে না। যাদের অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হবে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জুলাইয়ে এক গবেষণায় জানায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী অন্তত চার কোটি শিশু স্কুল শুরুর আগে প্রারম্ভিক শৈশবকালীন শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ সংকটের ফলে লাখো শিশুকে শ্রমে ঠেলে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা গণসাক্ষরতা অভিযানে উপপরিচালক কে এনামুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার যে কারণগুলো রয়েছে, মহামারিতে সেগুলোর ঝুঁকি আরো বাড়ছে। পরিবারের আয় কমে যাওয়া, খাদ্য ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রাথমিকে অনেকে ঝরে পড়বে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক শিশুশ্রমে নেমে যাবে। মাধ্যমিকে এর সঙ্গে যোগ হবে বাল্যবিয়ে। তবে অনেক দিন স্থবির থাকার পর স্কুল খুলছে। দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়ার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হবে। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গত জানুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন-২০২১ এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকের ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতের হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বাড়বে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পরবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, তা বের করতে হবে। এটা পুনরুদ্ধারে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার অর্জনগুলো ধরে রাখতে হবে। শিক্ষার জন্য দরকার একটা প্রণোদনা প্যাকেজ। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের জন্য বিকল্প পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।

জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে এই ঝরে পড়ার হার অনেক বাড়বে বলেই নিশ্চিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এবার করোনা ভাইরাস মহামারি এই সংখ্যা কোথায় নিয়ে যাবে তাই এখন শঙ্কার বিষয়।

তবে দীর্ঘ বিরতিতে শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটে পড়েছে তা সামলাতে মহামারির মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াকে ইতিবাচক মন্তব্য করে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম) আব্দুল্লাহ আল মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, পড়াশোনার বিকল্প পদ্ধতি থাকায় আমরা যতটা ক্ষতি হবে বলে ভেবেছিলাম এখন এসে মনে হচ্ছে ততটা হবে না। তবে কিন্ডার গার্টেন বন্ধ হওয়া, দারিদ্র্যতা বাড়াসহ কিছু কারণে বাল্যবিয়ে, শিশু শ্রমিক হিসেবে কিছু শিক্ষার্থী চলে যাবে। কাজেই স্কুল খুললেই পরীক্ষা ভীতি না দেখিয়ে তাদের আস্থায় আনা জরুরি।

আরো পড়ুন :
প্রস্তুতিতে পিছিয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
রাজধানীর বসিলায় জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযান, আটক ১

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আগামী শনিবার পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি রয়েছে। করোনায় পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া শহরাঞ্চলের নামিদামি স্কুলগুলো নিজেরাই জুম, গুগলসহ নানা মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। কিন্তু মফস্বলে টেলিভিশন না থাকা, ডিভাইসের অভাব, ইন্টারনেটের উচ্চ দাম ও দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারেনি। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা গত বছরের পুরোটাই ছিল পড়ালেখার বাইরে। এতে শিক্ষায় বড় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী আর নাও ফিরতে পারে স্কুলে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার যে কারণগুলো রয়েছে, মহামারিতে সেগুলোর ঝুঁকি আরো বেড়েছে। এটা পুনরুদ্ধার করা অনেক চ্যালেঞ্জিং।

সেপ্টেম্বর  ০৯.২০২১ at ১০:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি