প্রস্তুতিতে পিছিয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

আর বাকি দুই দিন। মহামারির দীর্ঘ বিরতির পর রোববার সারাদেশে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান। স্কুলে স্কুলে বাজবে ঘণ্টা। শিশুদের পদচারণায় মুখর হবে বিদ্যালয়ের আঙিনা। শ্রেণিকক্ষ ও আঙিনা আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। এ জন্য ১৯ নির্দেশনাও পাঠানো হয় প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছে। কিন্তু এর পরেও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুতিতে এখনও পিছিয়ে আছে।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার মেধা বিদ্যাপীঠের প্রধান ফটকের সামনে জমে আছে নোংরা পানি। ভেতরের মাঠেও তাই। একতলাবিশিষ্ট ক্লাসরুমগুলোর টিনের চাল ফুটো হয়ে বন্ধ কক্ষের ভেতরে জমেছে পানি। কিছু বেঞ্চে পচন ধরেছে, কাঠ পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। ভাদ্র মাসে মাঝেমধ্যে দিনের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টি ঝরছে। এতে পানি জমে থাকছে ভেতরে। কথা বলার জন্য বিদ্যালয়ে দায়িত্বশীল কাউকেই পাওয়া যায়নি।

পল্লবী থানার শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুলের ভেতরটা ধুলাবালিতে ভরা; লাইব্রেরির সামনেই ভাঙা ইট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে; উল্টে পড়ে আছে টেবিল। স্কুলের মাঠে বৃষ্টির পানি, ময়লা জমে আছে। মিরপুর ১০ নম্বরের মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট এবং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রাঙ্গণে ময়লা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচ একর জমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের ৪০টি ক্লাসরুমের সবক’টিই অবশ্য পরিস্কার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির খেলার মাঠ ও গাছের গোড়াগুলোও পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি সমকালকে বলেন, তারা ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করেছেন। তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনা হয়েছে। রোববার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান শুরু করতে আমরা প্রস্তুত আছি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুল বলেন, ‘মাউশির গাইডলাইন অনুসারে আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলমান। একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের একাধিক ক্লাসে বসানো হবে।

একটি ক্লাসের ছুটির কমপক্ষে এক ঘণ্টা পর আরেকটি ক্লাসের ছুটি হবে। এতে ছাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল থেকে বেরোতে পারবে। আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রতিদিন একাধিকবার মিটিং করছি। সে অনুযায়ী প্রতিটি শাখায় কাজ চলছে।’

এই অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তারা আগে থেকে তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করবেন, যাতে স্কুলে এসে তারা তা পালন করতে পারে।’

তবে করোনার সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানো নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। রোববার স্কুল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। বিশেষ করে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি শিক্ষার্থী হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়বে। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘স্কুল-কলেজ খোলার সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রত্যেক স্কুল-কলেজে কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের কঠোরভাবে মনিটরিং করতে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে হবে। এ ছাড়া ১২ বছরের ঊর্ধ্বে থাকা শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনারও দাবি জানাচ্ছি।’

এদিকে, ৪৪৩টি স্কুল-কলেজে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পরিচালনা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তিন দিনব্যাপী এই কর্মসূচির আওতায় ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মশক নিধন কার্যক্রম ও আঙিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। ‘শিক্ষার জন্য সুস্থ পরিবেশ’ শিরোনামে গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর এলাকার গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা স্কুলের মাঠ ও আঙিনা পরিস্কার করেন। আর মশককর্মীরা শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট, ভবনের ছাদ, আঙিনায় মশক নিধনের কীটনাশক লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড ছিটান।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার শুরুতে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছয় দিন ক্লাস হবে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। ফলে এই ক্লাসগুলোর শিক্ষার্থীরা বাকি দিনগুলোতে কীভাবে পড়ালেখা করবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অভিভাবকরা।

স্কুল-কলেজ খুললেও অনলাইন ক্লাসও অব্যাহত থাকবে। টেলিভিশনেও প্রচার হবে ক্লাস। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রতন চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছয় দিন হবে। বাকিদের সপ্তাহে একদিন ক্লাস হবে। এই শ্রেণিগুলোর জন্য বাকি পাঁচ দিন টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার করা হবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের যে ওয়ার্কশিট (অ্যাসাইনমেন্ট) দেওয়া হচ্ছে, তাও চলমান থাকবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যত ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন, সবই আমরা করব।’

প্রতিষ্ঠানগুলোই নিজ নিজ রুটিন তৈরি করতে পারবে :খোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ক্লাস রুটিন নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারবে। স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব মেনে শ্রেণি পাঠদান নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই রুটিন তৈরি করবে।

এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ গতকাল বুধবার রুটিন তৈরির একটি নির্দেশনা জারি করেছে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণিতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রুটিন তৈরি করবে।

নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে এবং অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আসবে সপ্তাহে এক দিন। রুটিন তৈরির জন্য ১০টি নির্দেশনা লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের। সেগুলো হলো- (১) ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে; (২) প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এক দিন প্রতিষ্ঠানে আসবে; (৩) সপ্তাহে প্রতিদিন নির্দিষ্ট শ্রেণিতে দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রুটিন তৈরি করবে; (৪) রুটিনের সঙ্গে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহারিক ক্লাস নির্ধারণ করা যেতে পারে; (৫) যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর সংযুক্ত রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান ওইসব স্তরের জন্য নির্ধারিত ক্লাসগুলো সমন্বয় করে রুটিন করবে; (৬) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলমান ডিগ্রি, সম্মান ও মাস্টার্স পরীক্ষার সঙ্গে সমন্বয় সাপেক্ষে ২০২১ ও ২০২২ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য রুটিন প্রণয়ন করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

আরো পড়ুন :
আওয়ামী লীগ নেতার নগ্ন ভিডিও নিয়ে তোলপাড়
শিবগঞ্জ ইউনিয়নে ২য় ডোজ টিকা নিয়ে কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন যুবলীগ নেতা সাফি

এতে আরও বলা হয়, (৭) রুটিন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, প্রস্থান ও অবস্থানের সময় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনা না ঘটে; (৮) রুটিন এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়; (৯) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আপাতত এসেম্বলি বন্ধ থাকবে; (১০) প্রতিদিন নির্ধারিত চেকলিস্ট অনুযায়ী তথ্য সরকারকে পাঠাতে হবে; (১১) পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ক্লাস রুটিন তৈরির ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে।

সেপ্টেম্বর  ০৯.২০২১ at ০৯:৪০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সম/রারি