সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর : বিচারকাজ দ্রুত শেষ হোক

ছবি- সংগৃহীত।

জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পূর্তি আজ ১৭ আগস্ট। দীর্ঘ ১৮ বছরেও সিরিজ বোমা হামলার বিচার শেষ হয়নি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের এই জঙ্গি সংগঠন পরিকল্পিতভাবে দেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে বোমা হামলা চালায়। মুন্সীগঞ্জ ছাড়া সব জেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক পয়েন্টে বোমা হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হন। জেএমবি সিরিজ বোমা হামলার পর এখনো দেশ থেকে জঙ্গি হামলার আতঙ্ক যায়নি। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে ভয়ংকর জঙ্গি সদস্য।

অনলাইন মাধ্যমে জঙ্গিরা তাদের প্রচার ও দাওয়াতি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ২০০০ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে জেএমবির আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ, রাজশাহীতে প্রকাশ্যে জঙ্গি কার্যক্রম, গাজীপুরে আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলা, ঝালকাঠিতে বিচারকদের ওপর বোমা হামলা, নেত্রকোনায় উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে খবর হয়ে ওঠে জেএমবির জঙ্গি কার্যক্রম। জেএমবির কার্যক্রম যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

আরো পড়ুন :

> নবজাতকের কান্নার কারণ জানাবে যে অ্যাপ
> ইবির ফার্মেসি বিভাগে ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা

জেএমবি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের তথ্য মিলেছে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান জানান দেয়। ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট ভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে জেএমবির দুর্র্ধর্ষ পলাতক জঙ্গি বোমারু মিজানকে গ্রেপ্তার করে ওই দেশের এনআইয়ে টিম। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল রাজধানীর গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়। ওই বছরের ২৭ মে মালিবাগে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলায় একজন পথচারী আহত হয়। একই বছরের ২৩ জুলাই রাতে খামারবাড়ি ও পল্টন পুলিশ বক্সে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা দুটি শক্তিশালী আইইডি যুক্ত বোমা ফেলে রেখে যায়।

সিরিজ বোমা হামলা ॥ ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার (মুন্সীগঞ্জ ব্যতীত) ৪৩৪ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় ৫৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। হামলার ১৮ বছরের মধ্যে ১১৮টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। ৪১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে এসব মামলায় ৭৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। ১৯৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। গ্রেপ্তারকৃত আসামির মধ্যে ২৮১ জনকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে ১৫ জনকে।

পুলিশ সদর দপ্তর ও র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি মামলা করা হয়। যার মধ্যে ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০ জন। গ্রেপ্তার করা হয় ৯৬১ জনকে। ১ হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

ঢাকা মহানগর আদালত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর এলাকায় বোমা হামলার ঘটনায় ওই সময় ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এই ১৮টি মামলায় পুলিশ ও র‌্যাব ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করে। ৫৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দেয়। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ঢাকার আদালতে ১৮টি মামলা ছিল। বর্তমানে ৪টি মামলা বিচারাধীন আছে। সেগুলোও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাক্ষীদের অনুপস্থিতিই মূল কারণ। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীদের পাওয়া যায়নি। সাক্ষীদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। পুলিশও চেষ্টা করছে সাক্ষীদের খুঁজে বের করতে। চাঞ্চল্যকর এসব মামলা চাইলেই তো শেষ করে দেওয়া যায় না।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, র‌্যাবের অভিযানেই জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, আসাদুল ইসলাম আরিফসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতারা গ্রেপ্তার হয়। তাদের বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছে। তাদের ফাঁসির রায়ও সরকার কার্যকর করেছে। এ কারণে আমরা খুব অল্প সময়ে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, দেশে জঙ্গি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। সিলেটে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার বলেন, কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা না থাকলেও কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, অতীতে জঙ্গিবাদে যারা জড়িত ছিলেন, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নতুন করে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। আজ ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত কয়েক বছর জঙ্গিবাদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও সাম্প্রতিক আবারও দেশকে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। জঙ্গি দমনে র‌্যাবের কোনো তৎপরতা আছে কি না জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাবের মূল ম্যান্ডেট জঙ্গি নিয়ে কাজ করা। এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৯টি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই পুরনো সংগঠনগুলোতে যারা এখনো তৎপর রয়েছেন।

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করতে চান, তারা একসঙ্গে বসে নতুন জঙ্গি সংগঠন করছেন। সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ায় তারা যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনটি আনসার আল ইসলামের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছিল। এই সংগঠনের আমিরসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংগঠনটি আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। নতুন করে তৎপর হওয়া জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ধরতে র‌্যাবের গোয়েন্দারা নিবিড়ভাবে কাজ করছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তার দাবি।

আগস্ট ১৭, ২০২৩ at ১৯:১১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দৈজক/ইর