ক্ষমতার রাজনীতিতে স্বস্তি কোথায়?

ছবি- সংগৃহীত।

রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত। বর্তমান সরকারের দুঃশাসন বিরোধী সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রাম নানা মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আন্দোলনে আগামী নির্বাচন কেমন হবে, কোন সরকারের অধীনে হবে এই প্রশ্নই সাধারণ মানুষের সামনে প্রধান হয়ে আসছে। সরকারের মেয়াদও শেষ হয়ে আসছে।

গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম গড়ে তুলে মেয়াদের আগে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা না গেলে ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা, এর আগে অক্টোবরের নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। ঘুরে ফিরে এই প্রশ্নই সামনে আসছে যে, বর্তমান আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, বর্তমান জাতীয় সংসদ অর্থাৎ সব সংসদ সদস্যদের পদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, ঐ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনের সুযোগ হবে কি?

আরো পড়ুন :

> খাগড়াছড়ির সফল কৃষি উদ্যোক্তা নুরুল আলম
> এইচএসসির প্রবেশপত্র বিতরণ শুরু মঙ্গলবার

সাধারণভাবে এই প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে যে, দলীয় সরকারকে ক্ষমতায় রেখে প্রকৃতভাবে জনমতের প্রতিফলন হয় এমন নির্বাচন অন্তত এখন আমাদের দেশে সম্ভব হবে না। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। নানা ধরনের কারসাজি হতে থাকবে।

বিগত দু’টি নির্বাচন ও অতীতের অধিকাংশ নির্বাচন প্রমাণ করেছে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে জনমতের প্রতিফলন হতে পারে, এমন নির্বাচন আশা করা যায় না। এখনো আমাদের দেশে এমন পরিবেশ তৈরি হয়নি যে, দলীয় সরকার ভালো নির্বাচন করবে। প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। নির্বাচন পরবর্তী শান্তিপূর্ণ বজায় রাখতে সবধরনের প্রচেস্টা নেবে।

এইসব বিবেচনা থেকে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রস্তাবিত তিন জোটের খসড়া রূপরেখায় অন্তত তিনবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বামপন্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, ঐ সময়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার মতো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন গড়ে উঠবে এবং সবার মধ্যে নির্বাচনী সংষ্কৃতিও যথাযথভাবে অনুসরণীয় হবে।

বামপন্থীদের এই প্রস্তাবে তখনো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সাড়া দেয়নি, একমত হয়নি। ঐ নির্বাচনের পর পরবর্তী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে সুষ্ঠু হবে না বিধায় আবার আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে নিজেদের মতো ‘গুটি সাজানো’ যে প্রধান কাজ, প্রধান কথা, এটা ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়নে একাধিকবারের তত্ত্ববধায়ক সরকারের ধারণাকে উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল।

শুধু তাই নয়, ঐ সময় ক্ষমতায় আসীন হয়ে তিন জোটের রূপরেখা, আচরণবিধি আর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে, নিজেদের দাবি তুলে ধরতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষেরা যেসব দাবি নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন তার সবই উপেক্ষিত থেকে গেছে আজ পর্যন্ত।

এই সময়ে নানা পালা বদল হলেও ১৯৯০ সালে যে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো হয়েছিল তার ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলা যায়নি। বরং কোথাও কোথাও আরও পোক্ত হয়েছে। নির্বাচন আসলে বা আগে থেকে নির্বাচন নিয়েই যেন সব রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। জনস্বার্থের অন্যান্য এজেন্ডা থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। কেউ কেউ বলতে পারেন, এখন যেহেতু প্রধান আলোচনা ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ তাহলে এত আলোচনা কেন?

আলোচনা এই কারণে যে, সাধারণ মানুষকে অন্ধ রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যখন মানুষ দেখবে, ‘আমাদের সমস্যা সমাধানে কিছুই তো হলো না’—তখন হতাশা বাড়বে। জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে। তাই সবসময় জনগণকে সংগঠিত করার সময় সচেতনতা তৈরিও হবে অন্যতম কাজ।

প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল রেখে নির্বাচনে হয়টা কী? ‘টাকার খেলা’, ‘মার্কার খেলা’, ‘প্রশাসনিক কারসাজি’, ‘যেনতেন প্রকারে বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার খেলা’।

তথ্যে দেখা যায়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখন ‘এমপিগিরি’ ব্যবসা হলো সবচেয়ে ভালো ব্যবসা। ব্যবসায়ীরা অর্থ বিনিয়োগ করে লাভের জন্য, যেখানে লাভ বেশি সেখানেই অর্থ বিনিয়োগ করে। পদ পদবী থাকলে, ক্ষমতার সাথে সুসম্পর্ক থাকলে এই ব্যবসা আরও ভালোভাবে করা যায়। তাই তো স্বার্থান্বেষীরা এর অনুকূল্য পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এসব মানদণ্ডে শাসকশ্রেণির দলগুলোর কাছে টাকাওয়ালা, ক্ষমতাশালীরাই প্রধান হয়ে ওঠে। প্রান্তিক হয়ে যায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এদের জন্য এখন চলতি কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘ভোটে দাঁড়ানোর জন্য এরা উপযুক্ত নয়।’

ঠিকই তো! ভোট ব্যবস্থাকে যদি ‘টাকার খেলা, পেশি শক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক আঞ্চলিক প্রচারণার’ বস্তুতে পরিণত করা হয়, এর সফলতার জন্য যদি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে প্রধান করে তোলা হয়—তাহলে তো দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা প্রান্তিক হবে। শুধু তাই নয়, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শাসকশ্রেণির দ্বি-দলীয় ধারার দলগুলোর নির্বাচনের সময় বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদীদের নিজ নিজ পক্ষে টাকা ও সহানুভূতি পাওয়ার জন্য মরিয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এর জন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ থাকবে উপেক্ষিত।

নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ করতে প্রয়োজন হলো গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, আমূল সংস্কার করা।

এটাও ফয়সালা করে নিতে হবে, সংসদ সদস্যরা সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও জাতীয় দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান অনুযায়ী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গুরুত্ব দিয়ে শক্তিশালী, কার্যকর ও আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন করতে হবে। এসব কাজে সর্বত্র জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণের কাজ পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকার জরুরি। তবে তা ভালো নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয়। এই ‘নির্দলীয় রেফারি’ টিমকে কার্যকর করতে এবং সংসদের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে ‘জাতীয়ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা’ চালু করতে হবে।

এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে তাদের কর্মসূচি তুলে ধরে সমর্থন চাইবে। জাতীয়ভাবে প্রার্থী তালিকাও প্রকাশ করবে। প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবে। এর মধ্য দিয়ে টাকার খেলা, পেশি শক্তির দূরত্ব কমে আসবে। স্থানীয় সরকারের হস্তক্ষেপও রহিত করা যাবে।

এছাড়া অন্যান্য সংস্কারও করতে হবে। এসব আসলে সংস্কারের জন্য সিপিবির ৫৩ দফা সুপারিশ করা আছে। সংগ্রামও পরিচালনা করা হচ্ছে। এই সংগ্রাম অব্যাহত রেখেই আমরা ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিষ্ঠার সাথে আগাতে হবে।

এসব আলোচনা যখন আমরা করছি, তখন দেশে নানা রাজনৈতিক নাটকীয়তা চলছে। দ্বি-দলীয় ধারার রাজনীতির নাটকীয়তা। নিজেদের বলয়ে নানা অংশকে সমবেত করে শক্তি তুলে ধরা, বড় জমায়েতের মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য দেশবাসীর কাছে হাজির করা ছিল পূর্বের রাজনৈতির সাধারণ কাজ।

সম্প্রতি মিডিয়াকে আকর্ষণ করা, কথার মারপ্যাঁচে আসল সমস্যা আড়াল করা, পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করা আর বিদেশিদের কাছে ধর্ণা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি তৎপরতা প্রতিদিনের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে যে বিদেশিদের অনুকূল্য লাগে এটা বলতে আর শাসকদের বাধছে না। দেশের মানুষের স্বার্থ যেন গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশে মুক্ত বাজারের নামে ফটকাবাজি ও লুটপাটের ধারার অর্থনীতি চলছে। চাকচিক্যের উন্নয়ন(!) এই অর্থনীতির সংকটকে ঢেকে রাখতে পারছে না।

অধিকাংশ মানষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। বাজার সিণ্ডিকেটের দখলে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন, অধিকাংশ মানুষ নিজের, পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। তরুণ, নতুন প্রজন্মের সামনে স্বপ্ন নেই, দুর্নীতি-লুটপাট-টাকা পাচার থেমে নেই। অর্থনীতিতে মূদ্রাস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট সরকার পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারছে না। এখনই এই সংকট উত্তরণে যথাযথ ভূমিকা নিতে না পারলে আরও বড় সংকটের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। অর্থনীতির লুটপাটের ধারা দুর্বৃত্তায়িত, লুটপাটের রাজনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।

এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে গণআন্দোলন, গণসংগ্রামের ধারাকে শক্তিশালী করতে হবে। বিকল্প তুলে ধরে ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম অগ্রসর করতে হবে। সম্প্রতি দলের নিবন্ধন, ঢাকার উপনির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, এই প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকারের অনড় অবস্থান, কথার পাল্টাপাল্টি আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ অনিশ্চিত করে তুলেছে। এইসব ঘটনায় দেশে নৈরাজ্য, সংঘাত ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী শক্তির অপতৎপরতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, নানা অশুভ শক্তির অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই অবস্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সংবিধান বহির্ভূত নানামুখী খেলা সংগঠিত করার সুযোগ করে দিতে পারে। তাই এই সময়ে ‘গদি ও গণবিরোধী নীতি’ পরিবর্তনে দেশের মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত হয়ে ভূমিকা পালন করতে হবে। রুহিন হোসেন প্রিন্স।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।

আগস্ট ০৪, ২০২৩ at ১৮:১৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ঢাপো/ইর