কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ও মানুষ-মেশিনের দ্বৈরথ

বিস্তারিত প্রথম কমেন্টে…

উড়িষ্যার একটি টিভি চ্যানেল ২০২৩ সালের ৯ জুলাই একজন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার টিভি সঞ্চালককে পর্দায় হাজির করে চতুর্দিকে একটা হইচই ফেলে দেয়। ভারত তো বটেই নিখিল বিশ্বে এই ঘটনা গুরুত্ব সহকারে নিউজ কাভারেজ পায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে সারা দুনিয়ায় বেশুমার মাতামাতি হচ্ছে। এবং এটা কত দ্রুত ‘হাতাহাতি’র পর্যায়ে যেতে পারে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সর্বত্র। মানুষের দিন কী তাহলে শেষ? এইরকম শঙ্কার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলেও এআই যে আগামী পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দেবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

আরো পড়ুন :

> মেসিকে টপকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে রোনালদো
> ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল

আমি প্রযুক্তিবিদ না হলেও প্রযুক্তি সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখার চেষ্টা করি। উড়িষ্যার টিভি চ্যানেলে এআই সঞ্চালক প্রকৃতার্থেই একটি চমৎকার ইনোভেটিভ আইডিয়া যার নাম দেওয়া হয়েছে লিজা।

প্রথমে অনেকে বুঝতেই পারবেন না যে, এটা কোনো কম্পিউটার ডিজাইন করা এবং প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন আপলোড করা একজন এআই সঞ্চালক! অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মানুষ সংবাদপাঠক, সঞ্চালকদের দিন আর বেশিদিন নেই! পরবর্তীতে এইরকম আরও কত ‘জন’-এর দিন শেষ হবে, এটা নিয়েই অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

তবে, এআই যে একটা বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এআই সঞ্চালক লিজা’কে মানুষের দুনিয়ায় স্বাগতম! কিন্তু এটা আদৌ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সঞ্চালক কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান কেননা এখানে লিজাকে কোনো বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে হয়নি।

কেবল কিছু আপলোড করা ডায়ালগ সাবলীলভাবে স্ক্রিনে হাজির হয়ে বলে দিয়েছেন। যেহেতু এখানে লিজাকে কোনো বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে হয়নি, তাই এটা এআই প্রযুক্তি কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে!

একথা অনস্বীকার্য যে, সারা দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রচুর মাতামাতি হচ্ছে এর অভিনবত্ব, সৃষ্টিশীলতা এবং সম্ভাব্য সৃজনশীল আর্টিকুলেশনের কারণে। কিন্তু এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আদতে কী জিনিস?

উইকিপিডিয়ায় ভাষায়, ‘মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয় যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মতো ভাবতে পারে। যেমন— শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হলো মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে এক ধরনের প্রযুক্তি যা অ্যালগরিদম ও মেশিন লার্নিং সুবিধা কাজে লাগিয়ে মেশিনের মাধ্যমে মানব মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিমত্তার মতো করে বিচার বিশ্লেষণ করে ফলাফল ও সিদ্ধান্ত অনুমান করে দিতে সক্ষম হয়।

মেশিন মানুষের মতো আচরণ করবে এবং মানুষের কাজ রোবট দিয়ে করানো যাবে এইরকম চিন্তাভাবনার সাথে মানুষ রোবট আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই এক প্রকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু মেশিন মানুষের মতো চিন্তা করবে, মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করবে, এটা মানুষের পক্ষে সহজে গ্রহণ করা কঠিন।

এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে, এতকাল পর্যন্ত যন্ত্র মানুষের শেখানোর বুড়ি আওড়াতে পারত কিংবা মানুষের তৈরি প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করত কিন্তু এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে সৃষ্ট যন্ত্র নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটাতে সক্ষমতা অর্জন করবে। ফলে, প্রাপ্ত তথ্য এবং উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এবং সক্ষমতা থাকবে বলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন তৈরি যন্ত্র নিজেই একটা ক্রিয়েটিভ যন্ত্রে পরিণত হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবিষ্কার, এর বিস্তার, পরিসর এবং এর কার্যক্ষমতা মানুষের সমাজে মানুষের প্রয়োজনকে অকার্যকর করে দিতে পারে কি না তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা, পরীক্ষা, নিরীক্ষা এবং গবেষণা চলছে।

মানুষ একটি লিভিং-অর্গান। সুতরাং মানুষের মধ্যে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা, নৈরাশ্য, প্রতিশোধ পরায়ণতা, ঘৃণা, ভালোবাসা প্রভৃতি কাজ করে। ফলে, অনেক সময় সিদ্ধান্ত অনুমানে মানুষ বিচার-বিশ্লেষণে তার ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মেশিন সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে বলে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা এবং ফলাফল বের করে ক্ষমতা অনেকটা তত্ত্ব, তথ্য ও বাস্তবসম্মত হবে।

তাছাড়া মানুষ কাজ করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। মানুষের বিরাম ও বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন ক্লান্ত হবে না। ফলে, তার বিরাম ও বিশ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন যেকোনো কিছু মানুষের চেয়ে সহজে এবং দ্রুত শিখতে পারবে।

তার স্মৃতিশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি হবে কারণ তার মধ্যে তথ্যভাণ্ডার আপলোড করে দেওয়া হবে। যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি একটি সুচিন্তিত কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে অনেক চিন্তা-ভাবনা এবং গবেষণার ফসল হিসেবে তৈরি করা হবে, তথ্য বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত অনুমানে এর নির্ভুলতার সম্ভাবনা মানুষের চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি হবে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

জুলাই ১৫, ২০২৩ at ১২:৫৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর