কাবুল দখল, আফগানিস্তানে আবারও তালেবানি শাসন!

আফগানিস্তানের সব রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য তালেবান প্রস্তুত।

দ্রুতগতিতে গোটা আফগানিস্তান নিজেদের দখলে নিয়েছে তালেবানরা। অবশেষে দেশটির রাজধানী কাবুলের রাজপথও এখন তাদের দখলে। শহরটির আকাশে উড়ছে অনেক হেলিকপ্টার। রাজধানী দখলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শুধু বাকি। তালেবান আতঙ্কে রাজধানী থেকে পালাতে চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষ। ক্ষমতার পালাবদলে ঘটতে পারে যেকোনো সময়। গুঞ্জন চলছে পদত্যাগ কিংবা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন দেশটির পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এ নিয়ে তীব্র আশংকায় দেশবাসী। দেশে ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার আশায় লাখ লাখ মানুষ সীমান্তে ভীড় করেছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানের প্রতিবেশি দেশগুলোকে তাদের সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউভুক্ত দেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ নিজের কূটনীতিক ও নাগরকিদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জোর তৎপরতা শুরু করেছে। তালেবানরা ঘোষণা দিয়েছে, রাজধানী থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছুক নাগরিকদের সুযোগ দেওয়া হবে। এরই মধ্যে রাজধানীর প্রবেশ পথের বিভিন্ন ভবনে তালেবানদের পতাকা উড়াতে দেখা গেছে।

এর আগে আফগান সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করা কাতার তালেবান বাহিনীকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে। যে কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিকে পদত্যাগ করতে হবে শর্ত দিয়েছে তালেবান। তাদের এ শর্ত মেনে নেওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত আফগান প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে এরই মধ্যে তালেবান তাদের যোদ্ধাদের কাবুলের প্রবেশ পথ দখলে নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ রবিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, কাবুল যেন শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে, সেজন্য আফগান সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “শান্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে যতক্ষণ না ঐকমত্য হচ্ছে, আমাদের যোদ্ধারা কাবুলের সব প্রবেশ পথে পাহারায় থাকবে।”

জঙ্গি গোষ্ঠীটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরাকে জানিয়েছে, তারা দেশের সমস্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবে।

আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে ঢুকছে চারপাশ থেকে। রাজধানীতে প্রবেশের সময় তালেবান যোদ্ধাদের তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে না বলে কাবুল থেকে জানিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম।

এর আগে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে করা এক টুইটে অবশ্য কাবুলের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, কাবুলের চারদিকে অনেকগুলো পয়েন্ট থেকে গুলির শব্দ শোনা গেছে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে শহরের ‘নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে’। কিন্তু তালেবানের আত্মসমর্পনের আহ্বানের পর আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি যুক্তরাষ্ট্রের দূত জালমাই খলিলজাদ এবং নেটোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছেন বলে খবর আসে।

এদিকে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে জরুরি আলোচনায় রয়েছেন।

গত মাসেই তালেবান যোদ্ধাদের সামনে সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধ কার্যত ধসে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে অনেকটা বিনাযুদ্ধে। সরকার সমর্থক দুই প্রভাবশালী মিলিশিয়া বাহিনীর নেতা আতা মোহাম্মদ নূর ও আবদুল রশীদ দোস্তামও পালিয়েছেন। নূর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, মাজার-ই-শরিফ যে প্রদেশের রাজধানী, সেই বলখ প্রদেশ ষড়যন্ত্র করে তালেবানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে এক বিবৃতিতে তালেবান বলেছে, তাদের একের পর এক অঞ্চল জয়, এটাই দেখাচ্ছে যে জনগণের কাছে তারা কতটা জনপ্রিয়। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আফগান জনগণ ও বিদেশি সবাই ‘নিরাপদে’ থাকতে পারবে বলেও আশ্বস্ত করেছে তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসলামিক আমিরাত (নিজেদেরকে এ নামেই পরিচয় দেয় তালেবান) সবসময়ই তাদের (জনগণ ও বিদেশি) জানমাল ও সম্মানের সুরক্ষা দেবে। জাতির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কর্মীদেরও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।”

আরো পড়ুন:
যাত্রীবাহী নোহা পুকুরে পড়ে সাতজন নিহত
ঠাকুরগাঁও মডেল উপজেলায় পরিণত হয়েছে : এমপি রমেশ

তবে এই আশ্বাস যে কাজে দেয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে গত এক সপ্তাহ ধরে কাবুলে বাড়তে থাকা উদ্বাস্তুদের ভিড় দেখে। বিভিন্ন প্রদেশের হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিতে ছুটে আসেন রাজধানীতে।

কট্টরপন্থি এই গোষ্ঠী কাবুলের খুব কাছে পৌঁছে যায় রবিবার (১৫ আগস্ট) ভোরের আগেই। সকাল থেকেই কাবুল শহরের চারিদিক থেকে ঢুকতে শুরু করে তালেবান। এর আগে শহরের চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে জঙ্গিগোষ্ঠীটি। শহর ছাড়তে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ।

আতঙ্কে সাধারণ মানুষ ও নারীরা:

দোহায় অবস্থানরত এক তালেবান নেতা রয়টার্সকে বলেছেন, তারা যোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে কোনো সহিংসতা না হয়। যারা কাবুল ত্যাগ করতে চায়, সে সুযোগ যেন তাদের দেওয়া হয়। তবে দেশের বিভিন্ন এলাকা তালেবানের দখলে চলে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তার আশায় কাবুলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল গত কয়েক দিন ধরে। এখন তারা কীভাবে মরিয়া হয়ে কাবুল ছাড়ার চেষ্টা করছেন, সেই বিবরণ বিবিসিকে দিয়েছেন আফগানিস্তানের নারী এমপি ফারজানা কোচাই।

তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, তারা আসলে কোথাও যেতে পারবে কি না, কোথাও যাওয়ার জায়গা তো তাদের নেই।’

ফারজানা কোচাই জানান, সব ফ্লাইট পূর্ণ, ফলে কাবুল ছাড়ার চেষ্টা যারা করছেন, তাদের আসলে শহরেই আটকে থাকতে হচ্ছে।

বিবিসিকে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের যেসব এলাকা আগেই তালেবানের দখলে চলে গেছে, সেসব এলাকার নারীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এখন আর তারা চাকরিতে বা স্কুলে যাচ্ছেন না। তার কণ্ঠে কেমন আতঙ্ক। তিনি বলেন, ‘নারীদের জন্য যে এমন ভাগ্য আসছে, সে তো জানাই ছিল। নারীদের তাদের ঘরের ভেতরে বন্দি থাকতে হবে।’

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানি শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীদের মুখ, চুলসহ সম্পূর্ণ দেহ ঢাকা বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। মেয়েদের বয়স ১০ বছরের বেশি হলেই স্কুলে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। শরিয়া আইনের নামে তারা চালু করেছিল দোররা ও পাথর ছুড়ে হত্যার মত ভয়ঙ্কর সব শাস্তি।

২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী তালেবানকে উৎখাত করেছিল আফিগানিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু দুই দশকেও সেখানে শান্তি আসেনি।

এ বছর ৯ মার্চ থেকে সেনা সরাতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত এপ্রিলে ঘোষণা দেন, দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তার দেশে সেনাবাহিনী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। সে সুযোগটিই কাজে লাগায় তালেবান। মে মাসে শুরু হয় তাদের হামলা। জুন মাসের শেষ দিকে সরাসরি আফগান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বাধে তাদের। তাতে আফগান বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এগোতে শুরু করে তালিবান।

তাদের দ্রুত অগ্রযাত্রায় একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানীর পতন দেখে সপ্তাহখানেক আগেও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলেছিল, আফগান সরকার হয়ত মাস তিনেক কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু কয়েকদিনের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় গত বৃহস্পতিবারের মধ্যেই দেশটির ৩৪টির মধ্যে ২২টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তালেবান পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়। এর পর কার্যত ঝড়ের গতিতে এগোতে শুরু করে তালেবান। একে একে হেরাট, আয়বাক, গজনি, কন্দহর, তালিকান, কুন্দুজ দখল করে তারা। উত্তর দিক থেকে কাবুলের প্রবেশ পথ মাজার-ই-শরিফও একদিনেই দখল করে নেয় তালেবান। তার পর রবিবার সকালে দক্ষিণের জালালাবাদ দখল করে তারা। রবিবার সকাল পর্যন্ত মোট ২৬টি প্রদেশ তালেবানের দখলে নেয়।

আফগানিস্তান ছাড়ছেন কূটনীতিকরা:

কাবুলে তালেবানের হামলার আগেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারতসহ ইউরোপ ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর নাগরিক ও কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। তালেবানদের আগ্রাসনের মধ্যে তারা এই তোড়জোড় শুরু করেছে। ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে আনতে সেখানে ৬ হাজারের মতো সৈন্য মোতায়েন করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।

যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে তাদের কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। কাবুল বিমানবন্দর ও দূতাবাস সুরক্ষিত করতে নতুন করে সেনাও পাঠিয়েছে তারা। অল্প কয়েকজনের একটি ব্যাচ আফগানিস্তান ছেড়েছে, কর্মীদের বেশিরভাগই দেশটি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। তবে দূতাবাসের কার্যক্রম এখনও পুরোদমে চলছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও মিত্র জোটের সেনা এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের ফিরিয়ে আনার জন্য দেশটিতে নতুন করে পাঁচ হাজার সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর পাশাপাশি যেসব আফগান নাগরিক মার্কিন সেনাদের বছরের পর বছর সহযোগিতা করেছে তাদেরকেও আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার কাজে সহযোগিতা করবে এসব সেনা।

ref : ভোরের কাগজ