রিক্সা হোক অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার মাধ্যম

কিছু দিন আগের কথা। তখন আমি থাকতাম যাত্রাবাড়িতে। যাত্রাবাড়ি থেকেই প্রতিদিন আসতাম বাড্ডাতে। একদিন হুট করে দেখি বাস আর চলছে না। ড্রাইভার বলল ‘নাইমা যান! সামনে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতাছে”। বাস থেকে নেমে দেখলাম না সত্যি এরা কোন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বিক্ষোভে নামে নাই। কারো পরনে প্যান্ট নাই, ভালো জুতা নাই, গায়ে সুন্দর জামা নাই, মুখে কেউ ক্রিম মাখছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। সবার কপাল বেয়ে মুখের ভাঁজ দিয়ে কেবল ঘামের ফোটা টপটপ করে নিচে পড়ছে। সাদা দাঁড়িওয়ালা বহু বৃদ্ধকে দেখেছি আন্দোলন করতে। তাদের স্লোগান দেখেই বুঝলাম তারাই প্রকৃত শ্রমিক। হ্যাঁ, কাছে গিয়ে বুঝলাম এরা রিক্সাওয়ালা।

আরো পড়ুন :
পাইকগাছায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান : জরিমানা আদায়
শিক্ষক ও এতিম শিশুদের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের মানবিক সহায়তা
পাইকগাছায় সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের উদ্বোধন

মেয়র সাহেব নাকি হাই রোডে রিক্সা চলা বন্ধ করে দিয়েছেন। ঢাকার শহলে চলবেনা রিক্সা। রিক্সা না চললে তারা খাবে কি!! রিক্সাওয়ালার তো আমার মত পড়া-লেখা জানা লোক না। রিক্সা না চললে অন্য কিছু করে খাবার মত তাদের কোন জো নেই। অথচ তাদের বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করেই হুট করে হাই রোডে উঠার উপর করা হয় নিষেধাজ্ঞা। বহু রিক্সাওয়ালার রিক্সার চাকার বাতাস ছেড়ে দিয়েছে ট্রাফিক। আবার দেখেছি বহু পুলিশকে রিক্সায় ছড়ে হাই রোডে উঠার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিতে। কঠিন এক অবস্থা বিরাজ করছিলো রিক্সাওয়ালাদের ভাগ্যের চাকা তখন। আমার মনে হয় তখনই সেই রিক্সাওয়ালা ভাইয়েরা করোনা দেখেছে। বাংলাদেশের গরিব মানুষগুলো এখন দেশের এই অবস্থা দেখে বুঝে পেলেছে করোনা মানেই মৃত্যু না, তবে করোনা মানেই যে ক্ষুদা তা তারা টের পাচ্ছে। তখনও এই গরিব রিক্সাওয়ালা ভাইগুলো তাদের জীবিকার তাগিদে তখনকার মানুষের সৃষ্টি করোনার ভয়কে জয় করেও রাস্তায় নেমে বেত্রাঘাত আর উৎকোচ প্রদান করে পরিবার চালিয়েছেন।

এবার প্রকৃত করোনায় কোনঠাসা হয়ে আছেন রিক্সাওয়ালারা। অঘোষিত লকডাউনে তাদের মাথায় যেন বজ্রপাত। অঘোষিত লকডাউন কতটা শুদ্ধ হয়েছে আর সরকার চাইলে যে এটাকে অঘোষিত না করে প্লান ভিত্তিক লকডাউন করতে পারতেন সেই ব্যাখ্যা দেয়াটা বেয়াদবি হতে পারে!! তাই সেই ব্যাখ্যাতে ইস্তফা টানলাম। এই অঘোষিত নামক লকডাউনে যাত্রীরা যখন ঘরে, রিক্সাওয়ালাও চলে গেলেন নিজ ঘরে। বাইরে আসলেই প্রশাসনের কঠোরতার সাথে সাথে কিছু পাতি লোকও তাদের চাকার হাওয়া আর গায়ে চপেটাঘাত করতে ভুলেন না। অথচ করোনায় মরতে লাগে ১৪ দিন। আর ক্ষুদায় এই রিক্সাওয়ালা ভাইরা মরছে প্রতিদিন। ঢাকার শহরে করোনায় অঘোষিত আর অপরিকল্পিত লকডাউনের কবলে প্রায় ১১ লাখ লোক হয়েছে কর্মহীন ক্ষুদার রাজ্যের বাসিন্দা।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলসের এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশের কেবল ঢাকাতেই রিক্সার সংখা ১১ লাখ। তারা যদি দৈনিক দু’টো শিফটে নূন্যতম রিক্সা চালাই তারা হয় ২২ লাখ। বস্তুত এই জরিপ অনুসারে এবারের অঘোষিত এবং অপরিকল্পিতি লকডাউনের আড়ালে বাংলাদেশের ২২ লাখ রিক্সাওয়ালাকে ক্ষুদার রাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে করোনায় মোকাবিলা করতে পারা দ্বায়িত্বশীলগুলো। সবাই বাঁচতে চাই। তাদেরকে বাাঁচানোর জন্য আগে পেটে ভাত তুলে দিয়ে তারপর না হয় রাস্তায় নামলে আপনি তাদের পিঠে কিলটা মারতেন!!

উপরোন্ত যা হয়েছে তো হয়েছে। এবার আসতে হবে সমাধানে দিকে। চলমান করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশে কি হয়েছে আর হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না। এগুলো স্রেফ বেয়াদবি হবে। আমাদের আসতে হবে সমাধানের দিকে। সরকার অবস্থার পর্যবেক্ষণে বারবার সাধারণ ছুটিকে অবস্থার আলোকে বাড়ানোকে আমি প্রশংসার চোখেই দেখি। একই পরিবারের অন্যরা যখন মোকাবিলা করার কথা বলে ইয়া নাফসিতেই আবদ্ধ, ঠিক তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একাই এই যুদ্ধে সত্যি প্রশংসনীয়।

আমাদের যেহেতু অর্থনিতীর চাকাকে সচল রাখতে হবে। আবার মানুষের জীবনকেও বিপন্নের দিকে ঠেলে দেয়া যাবে না। তথাপি আমাদের আবার সেই রিক্সাওয়ালাদের উপরই ভরসা করতে হবে। অর্থনিতিক চাকাকে সচল করার জন্য গণপরিবহন আমার মতে এই অবস্থায় গণমৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর গণপরিবহনে আদৌ সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। সরকার এবার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসাবে প্রত্যেক জেলা ভিত্তিক লকডাউন করে দিতে পারে। প্রতিটিা প্রতিষ্ঠান তাদের স্ব স্ব খরচে সামাজিক নিরাপত্তার সর্বোচ্চটা নিশ্চিত করে শ্রমিক নিয়ে আসতে পারে। জেলা ভিত্তিক চলবে এবার পরিকল্পিত লকডাউন। আর সেই পরিকল্পিত লকডাউনের মূল নায়কের ভুমিকায় থাকবে রিক্সা চালকগণ।

একমাত্র রিক্সার মাধ্যমেই সম্ভব এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখা।প্রতিটি রিক্সার আলাদা যত্ন নিতে হবে। সরকার নিশ্চিত করতে হবে রিক্সায় তাদের জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানো। রিক্সাওয়ালাদের পিপিইসহ স্বাস্থবিধির উপর দিতে হবে দারুণ প্রশিক্ষণ। এক রিক্সায় একজন বসবে। ভাড়া থাকবে নির্ধারিত। অফিস ঠিক থাকবে, গার্মেন্টস চলবে, শপিং চলবে। সবগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রাখার সর্বোচ্চ মাধ্যম এখন সেই হাই রোড থেকে তাড়িয়ে দেয়া রিক্সা।

ঢাকার শহরে এভাবে ১১ লাখ রিক্সা চললে আমার মনে হয় অর্থনৈতিক অবস্থার দারুণ একটা পরিবর্তন সরকার আনতে পারবে। একদিকে অর্থনৈতিক চাকা থাকবে সচল অন্যদিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টা হবে সুনিশ্চিত। ১১ লাখ রিক্সা ঢাকায় চললে ১১ লাখ কর্মহীন কমবে। তাদের রিক্সায় ভর করে কয়েক লাখ লোক কর্মস্থলে গেলে আরো কয়েক কোটি পরিবার তাদের জীবিকা পাবে। মালিকপক্ষ পাবে স্বস্তি। জীবনও থাকবে নিরাপদ।

অন্তত আরো কয়েকদিন থাকুক না গণপরিবহন বন্ধ। রাস্তায় চলুক সাধারণ লোকের অযথা চলাচল বন্ধ। তবে অর্থনৈতিক চাকা সচলে থাকুক সকল কল কারাখানা চালু। যাতায়াতের মাধ্যম হোক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অন্যতম পাথেয় রিক্সা। আর কল কারখানার ভিতরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি না হয় দেখবে মালিকপক্ষ।

লেখক :
সুলতান মাহমুদ আরিফ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

মে ১৮, ২০২০ at ২০:০৯:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এলআর/এএডি