স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক সালাম মাস্টার

ভাষা আন্দোলনে স্বক্রিয় ভূমিকা রাখার পর এখনো সরকারী গেজেটেড স্বীকৃতি পাননি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইনের পাইরোল গ্রামের ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুস সালাম মাস্টার।

প্রতি বছর একুশে ২১ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মান দেখানো হলেও সরকারী কাগজ পত্রে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই ভাষা সৈনিক।

জানা যায়, উপজেলার জঙ্গলখাইননের ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুস সালাম মাস্টার ১৯৩৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উপজেলার জঙ্গলখাইন গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মৃত আশরাফ আলী, মাতা মৃত আছোবা খাতুন।

ভাষা সৈনিক মাস্টার আব্দুস সালাম ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ১৯৫২ সালে ১৯ বছর বয়সেই তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তখন প্রাইমারী ও হাই স্কুলে পড়ার সময় উর্দু ভাষা সকল ধর্মের ছাত্রদের জন্য বাধ্যতমুলক ছিল। উর্দু ভাষা বাঙ্গালী ছাত্রদের শিখতে কষ্ট হতো। ক্লাসে উর্দু ভাষা বলতে না পারলে শিক্ষকেরা নির্মমভাবে ছাত্রদের মারধর করত। তখন থেকেই উর্দু ভাষার প্রতি ঘৃণা জন্মায় ছাত্রদের মনে। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে পটিয়া সদরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। তৎসময় পটিয়ায় ভাষা আন্দোলনের মিটিং, মিছিল ও বিভিন্ন সমাবেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভাষা সৈনিক আবদুস ছালাম মাস্টার, মফিজুর রহমান সাদা, আহমদ হোসেন, বজেন্দ্র নাথ শীল, সরেবিন্দু পালসহ অনেকে।
আরও পড়ুন:  মুজিববর্ষে চমক, আসছে ১০০ টাকার স্বর্ণমুদ্রা!

বর্তমানে ভাষা সৈনিকদের মধ্যে সালাম মাস্টার ছাড়া তারা এখন কেউ বেচেঁ নেই। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। ১৯৬২ সালে গৈড়লা কে.পি উচ্চ বিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে ১৯৮২ সালের দিকে অবসর গ্রহন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে গেরিলা বাহিনীর সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সিপিবির চট্টগ্রাম জেলার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। যুদ্ধকালীন সময়ে গেরিলা কমান্ডার ছিলেন কমরেড শাহ আলম তখন তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের গেরিলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

মাস্টার সালাম ছিলেন পটিয়া উপজেলা সিপিবির সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক ছিলেন ধীরেন দাশ। পরে একই কমিটি চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পটিয়ার বিভিন্ন এলাকার ও গৈড়লা স্কুলের প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে ভাষা সৈনিক সালাম মাস্টারের নেতৃত্বে অংশ গ্রহণ করেছেন। এদের অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের মধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ভাষ সৈনিক সালাম মাস্টারের ছাত্রদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক যুগ্ম পরিচালক ফজল আহমদ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী কমান্ডার যুগল সরকার, তাজুল মুল্লক চেয়ারম্যান, আবু বকরসহ অনেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনুপ্রানিত করেছেন। সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংগঠক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও ভাষা সৈনিক হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সরকারিভাবে ভাষা সৈনিক হিসেবে কোন স্বীকৃতি না পেলেও এ পর্যন্ত সম্মনা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক হিসেবে ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্মনাপত্র। ২০০০ সালে ৭ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক সম্মানা প্রদান, ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক সনদ পত্র প্রদান, ২০০৫ সালে মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ একটি সনদ পত্র প্রদান করেন।
আরও পড়ুন: যৌনকর্মীর লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে নামলেন পুলিশের ওসি

সালাম মাস্টারের ৫ ছেলে মেয়েদের মধ্যে সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও কেউ সরকারি কোন চাকুরী পাননি। ছেলে মেয়েদের মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠা করা পাইরোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বড় মেয়ে শিউলী আকতার ৫০০ টাকা বেতরে চাকুরী করেন। বর্তমানে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়েছে। বড় ছেলে আতাউস সালাম বিএ, বিপিএড পাশ করে সরকারি চাকুরী না পেয়ে কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানিতে সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত। মেয়ে শিল্পী আকতার বিএ, বিপিএড পাশ, আরেক মেয়ে সেলিনা আকতার বিএ, অর্নাস এম এ (ইতিহাস) চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পাশ করেছে। ছোট ছেলে সাইফুদ্দিন সালাম মিতু বিএসসি অর্নাস এম এ (ফলিত গণিত) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেও সরকারি চাকুরী পাইনি।

এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক সালাম মাস্টার বলেন, ‘আমি আমার ছেলে মেয়েদের জন্য কিছুই করতে পারিনি কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েদের ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চিনে এটা আমার বড় পাওনা। সরকার আমাকে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আমার জীবনটা পূর্ণ হবে, আমার আর কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই।’

এব্যাপারে ভাষা সৈনিক সালাম মাস্টারের ছোট ছেলে সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু বলেন, ‘আমার পিতা খুব সহজ সরল মানুষ। জীবনে কখনো অন্যায় অবিচারের কাছে মাথা নত করেনি। দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট দাবী জানায়, শেষ সময়ে যেন ভাষা সৈনিক হিসেবে আমার বাবাকে সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন।

এ ব্যাপারে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা বলেন, আমি সবেমাত্র এখানে নতুন যোগদান করেছি, ভাষা সৈনিক সালাম মাস্টারের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে জানানো হবে, এবং যাবতীয় সহযোগীতা প্রদান করা হবে।

দেশদর্পণ/এআর/এসজে