যৌনকর্মীর লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে নামলেন পুলিশের ওসি

‘পুলিশ জনগণের বন্ধু বা সেবক’ এমন প্রবাদ থাকলেও পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের কেন যেন আস্থা নেই। সেই অনাস্থা দূর করে পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে সমাজের ঘৃণার পাত্র যৌনকর্মীদের পাশে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান শুধু জানাজা নামাজ পড়িয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, কাঁধে নিয়েছেন যৌনকর্মীর মরদেহ। নেমেছেন কবরেও। দাফন কাজ শেষ করে ফিরেছেন কর্মস্থলে।

গোয়ালন্দ ঘাট থানায় যোগদানের পর প্রথম কোনো যৌনকর্মীর জানাজার ব্যবস্থা করে আলোচনায় এসেছেন ওসি আশিকুর রহমান। প্রশংসা কুড়িয়েছেন অনেকের। শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এভাবে একে একে তৃতীয় যৌনকর্মীর জানাজার ব্যবস্থা করলো পুলিশ

শনিবার দুপুর ২টার দিকে পারভীন বেগম (৬৫) নামে এক যৌনকর্মীর জানাজা শেষে স্থানীয়দের সঙ্গে তার মরদেহ কাঁধে তুলে নেন ওসি আশিকুর রহমান। এর মাধ্যমে তৃতীয় কোনো যৌনকর্মীর জানাজা অনুষ্ঠিত হলো।
আরও পড়ুন: যবিপ্রবিতে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয়ভাবে র‍্যাগ ডে

জানা গেছে, বহু বছর ধরে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন স্থানে পতিতাপল্লীর অবস্থান। সেখানে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার বাসিন্দার বসবাস। সেখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ যৌনকর্মী। এ পেশায় থাকার কারণে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে রয়েছে তাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে রয়েছে সকল অধিকার। স্বাভাবিকভাবে শুধু ভোটের মাধ্যমে তারা তাদের একমাত্র নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়। যৌনকর্মীদের মৃত্যু হলে কোনো ইমাম জানাজা পড়াতেন না এবং আশপাশ এলাকার কোথাও কবর দিতে দিতো না এলাকাবাসী।

যে কারণে কোনো যৌনকর্মীর মৃত্যু হলে এক প্রকার বাধ্য হয়ে মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম পতিতাপল্লীর পাশে একটি কবরস্থান করে দেন। পরবর্তীতে বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী কবরস্থানের চারপাশের বাউন্ডারি দেয়াল করে দেন। কবরস্থান থাকলেও জানাজা ছাড়াই মাটি চাপা দেয়া হতো যৌনকর্মীদের মরদেহ।

সেই প্রথা ভেঙে গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান চলতি মাসের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে হামিদা বেগম নামে এক যৌনকর্মীর জানাজা পড়িয়ে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন সম্পন্ন করে দেশে প্রথমবারের মত যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

তাৎক্ষণিক বিষয়টি গুরত্বের সঙ্গে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম প্রকাশ পায়। ওই জানাজা পড়ান দৌলতদিয়া রেলওয়ে মসজিদের ইমাম মৌলভী গোলাম মোস্তফা। যৌনকর্মীর জানাজা পাড়ানোয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন জন বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। যার প্রেক্ষিতে ওই ইমাম ঘোষণা দেন তিনি আর কোনো যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না।
আরও পড়ুন: উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কাফনের কাপড় পরে অনশনে শিক্ষার্থীরা

এদিকে পুলিশের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুয়াযী পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানেরে উদ্যোগে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে রিনা বেগম নামে আারেক যৌনকর্মীর জানাজা পড়ান গোয়ালন্দ ঘাট থানা মসজিদের ইমাম আবু বক্কর সিদ্দিক। এ সময় পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফকির আব্দুল জব্বার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সালাহউদ্দিন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মামুন, গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের ওসি আশিকুর রহমান, দৌলতদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মন্ডলসহ স্থানীয় এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে এর একদিন পর শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে পারভীন বেগম নামে আরেক যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানোর মাধ্যমে তৃতীয় কোনো যৌনকর্মীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে যৌনকর্মীদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়ানো অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। জানাজা শেষে মৃত যৌনকর্মীদের পতিতাপল্লীর পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান জানান, আসলে মানবিক দৃষ্টি কোণ থেকে তিনি খাটিয়া কাঁধে নিয়েছিলেন, অন্য কিছু চিন্তা করে নয়। জানাজা শেষে অনেকে চলে যাওয়ার পর যারা খাটিয়া কাঁধে নিচ্ছিলেন তাদের মধ্যে লম্বায় সবাই সমান ছিলেন না। সামনের দিকে যিনি ছিলেন তিনি অনেক লম্বা, তাই খাটিয়া উঁচু নিচু হচ্ছিল। যে কারণে তিনি খাটিয়া কাঁধে নিয়েছিলেন। এছাড়াও কবরে তো সবাই নামতে চায় না, তাই তিনি নেমেছিলেন।

তিনি বলেন, আস্তে আস্তে সবার মাঝে যখন বুঝ আসবে, তখন আমাদের এসব কাজ করতে হবে না। তখন স্থানীয়রাই সব করবেন। তবে পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশনায় পুলিশ সব সময় যৌনকর্মীদের পাশে থাকবে।

দেশদর্পণ/এসজে