সড়কে আপন মনে এঁকে যাচ্ছেন চিত্রকর্ম, লিখছেন মনের কথা

পরিচয় জানতে চাইলে সড়কের উপর চক দিয়ে বড় বড় করে লিখছেন—‘বাড়ি ছিল দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল, বিশাল এক নদীর তীরে ’। উৎসুকদের এ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে দেখে লিখছেন—‘এগুলো মোবাইলে তুলে তুলে যে নেটের ভেতর ছাড়বে তাকে অভিশাপ দেব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এগুলোর কোনো মর্যাদা দেয় না’। আবার কোথাও ইংরেজিতে বড় করে লেখা—‘ডু নট ওয়াইপ (মুছব্নে না)’। কিন্তু উৎসুক জনতা মোবাইল ফোনে ছবি তোলায় বিরক্ত হয়ে পরে নিজেই পানি দিয়ে সেগুলো ধুয়ে দিচ্ছেন।

রোববার (১৭ অক্টোবর) গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌর শহরের পুরাতন ব্যাংকের মোড় থেকে খেয়াঘাট সড়কে যাওয়ার পথে কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কালীগঞ্জ ডাকঘরের সামনে দেখা মেলে এক চিত্রকর্মের। বয়স চল্লিশের বেশি হবে। পরনের পোশাক মলিন। চুল উসকো-খুসকো। পাশে রাখা একটি পুটলি। তবে আশপাশে খেয়াল নেই তার। একমনে ছবি এঁকে চলেছেন।

কেউ বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে মুখে কিছু বলছে ন না। দেখিয়ে দিচ্ছেন চিত্রকর্মের পাশে তার বিভিন্ন লেখা ও উপদেশ। আবার কেউ তার আঁকা ছবি মোবাইল ফোনে বন্দি করতে চাইলে তার দিকে তেড়ে আসছেন।

অদ্ভুত এ ব্যক্তিকে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সড়কে জটলা বেঁধে যায়। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামিয়ে এক পলক দেখে নেন কথা না বলা মানুষটার চিত্রকর্ম।

কালীগঞ্জ পুরাতন ব্যাংকের মোড় থেকে খেয়াঘাট সড়কে যাওয়ার কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও উপজেলা ডাকঘরের সামনে মানুষের জটলা। সকাল থেকেই সাধারণ মানুষের ভিড় লেগে আছে ওই ব্যক্তিকে ঘিরে। উৎসুক জনতার মধ্যে কেউ কেউ সাদা কাগজ এনে দিচ্ছেন ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। লোকটি কাউকেই নিরাশ করছেন না।

ময়লা কাপড়-চোপড় পরা মানুষটি মুখে মাস্ক লাগিয়ে আপন মনে চিত্রকর্ম এঁকে যাচ্ছেন। তবে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না।

এঁকেছেন একটি লতানো গাছ। তাতে বসা দুটি পাখি। পোড়া কয়লা (কালো), ইটের টুকরো (লাল), গাছের পাতা (সবুজ) ও চক (সাদা) রং চিত্রকর্মের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন।

চিত্রকর্মের পাশে লিখেছেন ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’, ‘পথ চলতে খাবার-দাবারে খুব সমস্যা যদি কারো মন চায় কিছু হেল্প করতে পারেন’, ‘টাকা-পয়সা দুইদিনের, ভালোবাসা চিরদিনের’, ‘জগতের সব মানুষ সমান না, সব মানুষ মানুষ না’, ‘কথা বলার মতো মন মানসিকতা সব সময় থাকে না’—এ ধরনের আরও অনেক কথা লিখেছেন এ চিত্রশিল্পী।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলে আশপাশের পথচারী এবং দোকান মালিকরা তার জন্য খাবার নিয়ে আসেন। তবে এদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। আপন মনে আঁকতে থাকেন বাহারি সব আল্পনা। অনেক অনুরোধ করলেও হাত দেননি খাবারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ দৃশ্য ভাইরাল হতে থাকলে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

কালীগঞ্জ পৌর এলাকার দড়িসোম গ্রামের বাসিন্দা আলিফ সিরাজ বলেন, তিনি সকালে যখন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রাস্তার ওপর এমন চিত্রকর্ম দেখে থমকে দাঁড়ান। হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েও যে কিছু করা যায় তা তিনি এই লোকের কাছ থেকে শিখেছেন।

আরো পড়ুন:
২১ যাত্রী নিয়ে বিমানে আগুন
এলাচ ভেজানো পানি স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী

কালীগঞ্জ উপজেলা ডাকঘরের উদ্যোক্তা মো. বিল্লাল হোসেন রুবেল বলেন, আমি যখন সকালে পোস্ট অফিসে কাজ শুরু করি তখন থেকে দেখি ওই লোকটা আঁকাআঁকি শুরু করেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে চিত্রকর্মের দৈর্ঘ্য। বিষয়টি খুব দ্রুত স্থানীয়ভাবে ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সত্যি! অসাধারণ আঁকেন মানুষটি।

রিয়াদ হোসাইন বলেন, তিনি মোটরসাইকেলে করে এ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে মানুষটির চিত্রকর্ম। মোটরসাইকেল থামিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও পারেননি। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কিভাবে এতটা প্রতিভার অধিকারী হতে পারে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

রিয়াদ হোসাইন বলেন, আমি ছবি তুলতে গিয়েছিলাম পরে দেখলাম সে বাধ সাধছে। তাই তাকে আর বিরক্ত না করে চলে এসেছি।

কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইকবাল চৌধুরী বলেন, তিনি স্কুল ক্যাম্পাসে থাকেন। তাই খুব কাছ থেকে বিষয়টি দেখার সুযোগ হয়েছে। সকাল থেকে ওই লোকটি সড়কে বিশাল এক চিত্রকর্ম করেছেন। তিনি প্রকৃতি থেকে রং নিয়েছেন। তবে মুখে কিছু বলছেন না। শুধু আপন মনে এঁকে চলেছেন। অপরিচিত এ মানুষটির প্রতিভায় তিনি অবাক হন।

তিনি বলেন, চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিটির স্বাভাবিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরিচয় পাওয়া না গেলেও তার চিত্রকর্ম এবং হাতের লেখা দেখে অনুমান করা যায় তিনি শিক্ষিত এবং ভদ্রগোছের মানুষ। শরীরের কাপড় চেষ্টা করেছেন গুছিয়ে রাখতে। মাথায় অল্প সাদাকালো চুল আর মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি। কথাবার্তা মোটেই বলেন না। তবে মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে কিছু বলেন যা বোঝার সাধ্য নেই।

অক্টোবর  ২০.২০২১ at ১৭:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/জানি/জআ