পরমাণু বোমার জনক কে এই রবার্ট ওপেনহাইমার?

ছবি- সংগৃহীত।

পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তার নাম ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। সেই বোমা তৈরির প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে নিয়ে হলিউডে নির্মিত একটি সিনেমা চলতি সপ্তাহের শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে, আর সে কারণেই এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন করে আগ্রহ। জাপানের দুটি শহরে এই বোমা ফেলার পর যে বিপুল প্রাণহানি এবং ধ্বংসলীলা ঘটেছিল তা এই বোমা তৈরির সময়ই অনুমান করেছিলেন ওপেনহাইমার, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু ও বিশ্ব ধ্বংসকারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেদিন (১৯৪৫ সালের) ১৬ জুলাই সালের ভোরবেলা, সেখানে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে- যার সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি। বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটি কন্ট্রোল বাংকারের ভেতরে কাউন্টডাউনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রকল্পটির প্রধান বিজ্ঞানী ও পরিচালক রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা ওপেনহাইমার চিরকালই ছিলেন হালকা-পাতলা।

আরো পড়ুন :

> পাকিস্তান-আফগানিস্তানে আকস্মিক ভারী বর্ষণে বন্যা-ভূমিধসে নিহত ৪৪
> ৯০ বছর বয়সে বডিবিল্ডিংয়ে বিশ্ব রেকর্ড

কিন্তু ম্যানহাটান ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্টের বৈজ্ঞানিক শাখা ‘প্রজেক্ট ওয়াই’- যারা বোমাটির ডিজাইন বা নকশা তৈরি করেছিল- তার পরিচালক হিসেবে তিন বছর কাজ করার পর তার ওজন আরো কমে গিয়ে ৫২ কেজিতে নেমে এসেছিল। আরো শীর্ণকায় হয়ে গেছিলেন তিনি।

পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের আগে তিনি ঘুমিয়েছিলেন মাত্র চার ঘণ্টা। একদিকে দুশ্চিন্তা, আরেক দিকে ধূমপানজনিত কাশি- তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। ওপেনহাইমারের জীবনে ১৯৪৫ সালের সেই দিনটি ছিল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর অন্যতম। তার ওপর ২০০৫ সালে ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন ইতিহাসবিদ কা বার্ড আর মার্টিন জে শেরউইন। হলিউডে ওপেনহাইমার নামে যে ছবি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাচ্ছে শুক্রবার- তা রচিত হয়েছে এ বইটিকে ভিত্তি করেই।

বিস্ফোরণের কাউন্টডাউন শুরু হবার মুহূর্তে ওপেনহাইমারকে দেখছিলেন পাশে থাকা একজন সামরিক কর্মকর্তা। বার্ড আর শেরউইন বর্ণনা করেন, সেই জেনারেলটি বলছিলেন যে, ‘শেষ কয়েকটি সেকেণ্ডে ড. ওপেনহাইমার যেন আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছিলেন, তার শ্বাস পড়ছিল না।’

তারপরই ঘটলো সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তার ঔজ্জ্বল্য সূর্যকেও ম্লান করে দিল। একুশ কিলোটন টিএনটির ক্ষমতাসম্পন্ন সেই বিস্ফোরণ ছিল তখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম। এর ফলে যে শকওয়েভ বা বাতাসের ঝাপটা তৈরি হয়েছিল তা শত মাইল দূর থেকেও অনুভব করা সম্ভব হয়েছিল। প্রচণ্ড গর্জনে মরুভূমি কেঁপে উঠলো, আকাশে পাকিয়ে উঠলো মাশরুম আকৃতির মেঘ। ওপেনহাইমারের মুখে এবার এক বিরাট স্বস্তি ফুটে উঠলো। কয়েক মিনিট পর ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রাবি দেখলেন, হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। আমি কখনো তার সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলবো না, ভুলবো না যেভাবে তিনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। সেটা ছিল ‘হাই নুন’ ছবির মতো একটা দৃপ্ত ভঙ্গী – যাতে ফুটে উঠছিল যে তিনি তাকে দেয়া কাজটা করতে পেরেছেন।

বেশ কিছুকাল পরে ১৯৬০-এর দশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার গভীরতর অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার। তিনি বলেছিলেন, বিস্ফোরণের পর পরই তার মনে পড়েছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রমদ্ভগবদ্গীতার একটি উদ্ধৃতি, ‘এখন আমি পরিণত হয়েছি সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, বিশ্ব ধ্বংসকারীতে।’

তার বন্ধুদের কথায়, পরবর্তী দিনগুলোতে ওপেনহাইমারের মধ্যে একটা বিষণ্ন তা ভর করেছিল। একজন বলেছেন, রবার্ট চুপচাপ আর আনমনা হয়ে গেছিল, কারণ সে জানতো কী ঘটতে যাচ্ছে। একদিন তাকে জাপানিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে বিড়বিড় করতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, আহা ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো, ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো!

কিন্তু কয়েক দিন পরই তার হাবভাব আবার পাল্টে যায়। সামরিক নেতাদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বারবার তাদের বলে দিচ্ছিলেন যেন বৃষ্টি বা কুয়াশার সময় বোমাটা ফেলা না হয়, বা খুব বেশি উঁচুতে বিস্ফোরণ ঘটানো না হয়- তাহলে ততটা ক্ষয়ক্ষতি হবে না।

হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা ফেলার পর সহকর্মীদের সামনে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে যে ভঙ্গি করেছিলেন- তা ছিল বিজয়ী যোদ্ধার মতোই।

ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। পরমাণু বোমাকে বাস্তবে রূপদানে তার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধ পরবর্তীকালে তার এক সহকর্মী জেরেমি বার্নস্টাইন বলেছেন, লস আলামোসের ওই প্রকল্পে যদি ওপেনহাইমার না হয়ে অন্য কেউ পরিচালক হতেন তাহলে যুদ্ধ শেষ হতো ঠিকই- তবে পারমাণবিক বোমা ছাড়া।

এই বোমা সফলভাবে তৈরির ব্যাপারে ওপেনহাইমারের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচিত্র। এক এক সময় তার মধ্যে যেমন উত্তেজনা আর উচ্চাভিলাষী মনোভাব দেখা গেছিল- তেমনই ছিল বিষাদ ও গ্লানি। একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও তার মধ্যে দেখা গেছে একজন বড় নেতার গুণাবলী ও সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব।

ওপেনহাইমারের চরিত্রে এই স্ববিরোধিতা নাকি অল্প বয়স থেকেই ছিল এবং এজন্য তার বন্ধু ও জীবনীকারদের কাছে তিনি ছিলেন একটা ধাঁধাঁ হয়ে।

জুলাই ২৪, ২০২৩ at ১২:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর