ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি, দু’ভাই বরখাস্ত

সাতক্ষীরার তালায় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরীপ্রাপ্ত দু’সহোদরকে তাদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

গত ১৯ জুলাই ২৩’ সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমী স্বাক্ষরিত পত্র যার স্মারক নং ৩৮.০১.৮৭০০.০০০.০৪.০০৪.২০-১২৩২ ও ৩৩ মাধ্যমে তাদেরকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র দাখিল করে নিয়োগ পাওয়ার বিয়য়টি প্রমাণিত ও ২য় কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে অভিযুক্তরা স্বীকার করেন যে, নিয়োগ লাভের বহুকাল পরে গত ২৪/১০/২২ তারিখে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তালা শাখা তাদের পিতার নাম সম্বলিত তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠিয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা দাবীদার ললিত মোহন সাহার নামে দাখিলকৃত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদ যার নং ১৪৮৬০, তাং ১৯/৪/২০০৩ সঠিক নয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মতামত থেকে প্রমাণিত হয় যে, অভিযুক্তরা অসত্য তথ্য প্রদান ও ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করে নিয়োগ লাভ করেন।

আরো পড়ুন :

> গাজীপুরে জীবন দহ্মতা ও শিশু সুরহ্মা বিষয়ক লার্নিং ক্যাম্প ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত
> প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতির ধারক বাহক জারীগান ও জারী শিল্পীরা আজ বিলুপ্তির পথে।

এর আগে গত ৬জুন ২৩’ সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমী স্বাক্ষরিত পত্রে যার স্মারক নং- ৩৮.০১.৮৭০০.০০০.০৪.০০৪.২০-৯৬০ ও ৬১ মাধ্যমে অভিযুক্ত তালার আসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রতাপ কুমার সাহা ও একই উপজেলার সরুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বীরেন্দ্রনাথ সাহাকে কারণ দর্শানো নোটিশে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী এর ৪ (৩)(ঘ) মোতাবেক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত কেন কার্যকর হবেনা তার কারণ দর্শাতে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ২য় কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্তরা তাদের নিয়োগের বহুকাল পর ২৪/১০/২০২৩ তারিখে তালা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তাদের পিতা ললিত মোহন সাহার নাম সম্বলিত তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠিয়েছে যা, জামুকার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

এছাড়া ঐ পত্রে উল্লেখ থাকে যে, বিভাগীয় মামলায় গত ২৭/১০/২০২২ তারিখের শুনানীতে অভিযুক্তরা তার পিতা ললিত মোহন সাহার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদর্শনে ব্যর্থ হন এবং সন্তোষজনক জবাব প্রদান করেননি।
প্রসঙ্গত, তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর প্রামের মৃত বসন্ত সাহার ছেলে মৃত লোলিত মোহন সাহা জীবদ্দশায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে একাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রস্তুত করেন। যার একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদপত্র, যার স্মারক নং-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯-০৪-২০০৩। যার সার্টিফিকেট নং-১৪৮৬০।

এর অন্তত ৬ বছর পর ২০০৯ সালের ১৫ মে’ যুদ্ধকালীণ খুলানা বিভাগের লে: অবসরপ্রাপ্ত গাজী রহমতুল্লাহ দাদুর কাছ থেকে প্রত্যায়নপত্র গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ললিত মোহন সাহা। এরপর তার মৃত্যুর ৫ বছর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে আতাউল গনী ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশরক্ষা বিভাগের স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র। একই বছরের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা সংসদের কমান্ডার মফিজ উদ্দিনের নিকট থেকে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন পত্র, দু’দিন পর ৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন (মশু), একই বছরের ১৫ জুলাই ধানদিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো: তবিবর রহমানের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়নপত্র গ্রহণ করেন।

মূলত এসব সনদে ললিত মোহন সাহার দু’ ছেলে যথাক্রমে বীরেন্দ্র নাথ সাহা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ০৫/০২/ ২০০৮ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নং প্রাশিঅ/নিয়োগ/স:শি:নি/০১/২০০৮/২৯ মোতাবেক পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল ও ২৬/০৪/২০০৯ তারিখে নিয়োগ লাভ করেন। এবং প্রতাপ কুমার সাহা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১৪/০৫/২০০৯ তারিখের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নং প্রাশিঅ/নিয়োগ/০৪/স:শি:নি/০৯/৬৮৪ মোতাবেক উক্ত সনদ দাখিলপূর্বক ২৬/০৯/২০১০ তারিখে নিয়োগ লাভ করেন।

প্রত্যায়নকারীদের মধ্যে মো: তবিবর রহমান প্রত্যায়ন দেওয়ার পর জানতে পারেন যে, ভূয়া তথ্য দিয়ে ললিত মোহ সাহার ছেলেরা তাকে বিভিন্ন জাল, তঞ্চকী সনদসহ ভূয়া প্রত্যানপত্র দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রত্যায়নটি নিয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়াবলী জানতে পেরে তবিবুর রহমান ললিতের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও তার দেওয়া প্রত্যায়নপত্রটি নিয়ে সাতক্ষীরা আমলী আদালতে প্রতাপ কুমার সাহা ও তার ভাই বীরেন্দ্র নাথ সাহার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। যার নং সিআর-১৯৬/২০(পাট), ধারা: ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪১৭ ও ১১৪ দঃবিঃ।

আদালত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই সাতক্ষীরাকে নির্দেশ প্রদান করেন। সাতক্ষীরার এসআই সৈয়দ রবিউল আলম পলাশ দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত ২০/৪/২১ তারিখে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে ১নং বিবাদী প্রতাপ কুমার সাহা ও ২ নং বিবাদী বীরেন্দ্র নাথ সাহা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় দাখিলকৃত তাদের পিতা ললিত মোহন সাহার নামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের স্মারক নং-মুবিস/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯/০৪/২০০৩ মূলে ১৪৮৬০ নং ক্রমিকের সাময়িক সনদপত্রটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় হতে যাচাই করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপ সাচব (সনদ) ডা: দুলাল কৃষ্ণ রায় স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৮.০০.০০০০.০০৩.৫০.০৩০.১৮.৬১ তারিখ-২৩/০২/২০২১ এর মাধ্যমে জানানো হয় সাময়িক সনদপত্রটি সঠিক নয়। এছাড়া তারা জাল সনদকে আসল সনদ হিসেবে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অদ্যবধি সরকারি তহবিলের অর্থ গ্রহণ করায় তাদের বিরুদ্ধে দি পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪২০ ধারার অপরাধ পাওয়া যায় বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।

এর আগে পিতা ললিত মোহন সাহার মৃত্যুর ৩ বছর পর তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করতে তার বড় ছেলে জোগেশ চন্দ্র সাহা গত ২৮/১০/২০১৩ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি গত ১/১০/২০১৫ তারিখে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিকে প্রেরণ করেন।

এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মৃত ললিত মোহন সাহাকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই তালিকা থেকে বাদ দিতে ও তালিকায় অন্তর্ভুক্তি না করতে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তালাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক আবেদন করেন।

দাদু ললিত মোহনকে মুক্তিযোদ্ধা দেখিয়ে ভুয়া সনদে বাবা-কাকাদের বিভিন্ন সরকারি চাকরি গ্রহনের জারী-জুরি ফাঁস হওয়ায় সর্বশেষ যাচাই-বাছাই কার্যক্রমকে প্রভাবিত ও এরআগে উত্থাপিত জাল সনদপত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে চুড়ান্ত সনদপত্র সংগ্রহর জন্য বিভিন্ন মহলে ব্যাপক দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে ললিতের পৌত্র সুমন সাহাসহ তার স্বজনও অনুসারীরা।

এমনকি কথিত মুক্তিযোদ্ধা ললিতের তঞ্চকতাপূর্ণ সার্টিফিকেট’র তথ্য ফাঁস হওয়ায় অনলাইন আবেদন ঠিক রেখে নতুন করে সার্টিফিকেট প্রস্তুত করতে পরিবারের পক্ষে বিভিন্ন মহলে দৌড় ঝাঁপের পর সর্বশেষ যাচাই-বাছাই তালিকায় নাম সম্পৃক্ত করতে উঠে-পড়ে লাগে। সর্বশেষ কমিটির একটি পক্ষকে ম্যানেজ করে দ্বিধা বিভক্ত তালিকায় নাম সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হলেও শেষ রক্ষা হয়নি।

মূলত সর্বশেষ যাচাই-বাছাই তালিকায় দ্বিধা-বিভক্ত তালিকায় কেবল নাম সম্পৃক্ত হলেও ২০০৮-০৯ সালে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় তার ছেলেদের প্রদর্শিত সাময়িক সনদপত্রটির উৎস্য আসলে কি? এমন নানা প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে জনপদেরর সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদ্ধের কাছে। এব্যাপারে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদেরকেও আইনের আওতায় নেওয়ার দাবি জানান।

এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক দৌড়-ঝাঁপের পর সর্বশেষ তাদের বরখাস্তের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বস্তি এনে দিয়েছে। এমনকি সুষ্ঠ তদন্তপূর্বক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানিয়েছে তারা।

জুলাই ২২, ২০২৩ at ১২:৫০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মোরোটি/ইর