ভাষার মাস শুরু হলো আজ

মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবন বিপন্ন করা এমন নজির বিশ্বে বিরল। ছবি- সংগৃহীত।

ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু (০১ ফেব্রয়ারি) বুধবার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষায় ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামেন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের সাহসিকতা ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ওই দিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল বাঙালি জাতি।শোকাবহ এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গৌরব আর অহঙ্কারের অধ্যায়।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেদিক থেকে মূলত ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবন বিপন্ন করা এমন নজির বিশ্বে বিরল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের নামে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে। সেসময় পাকিস্তানের শাসকরা উর্দুকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসে। সাথে সাথেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার মানুষ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে বাঙালির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে ক্রমেই জোরালো হতে থাকে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ইস্যু।

১৯৫২ সালের শুরুতে বাঙালির সেই আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। সেবছর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলন দমাতে ১৪৪ ধারা জারি করে জনসমাগম, জনসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ সেখানে নির্বচারে গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না-জানা অনেক ভাষার যোদ্ধারা। এরপরই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। তারপরদিনই সারারাত জেগে শহীদদের স্মরণে গড়া হয় শহীদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে পুরো জাতির ভিতরেই জন্ম নেয় একটি চেতনার বীজ। তাই আবারও গড়ে ওঠে নতুন শহীদ মিনার।

১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার গভীরে জন্ম নিয়েছিল ‘একুশ’ নামের এক চেতনা। যে চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র রোপন করেছিলো। আমাদের ইতিহাসে পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণআন্দোলনের ভয়ানক উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে এই মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়েই প্রথমবার এদেশের অধিকার-বঞ্চিত মানুষের মধ্যে সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির যে আত্মপরিচয় ও মর্যাদার উন্মেষ ঘটেছিলো, নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সেটাই রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। সংকটের নানান আবর্তে একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি বহু অসাধ্যকে।

আরো পড়ুন:
>২আসমিসহ মাদক উদ্ধার চন্দনাইশ থানার অভিযানে
>বেনাপোলে হুন্ডির ১৩ লাখ টাকাসহ হুন্ডি ব্যবসায়ী আলমগীর আটক

একুশ বাঙালির জাতীয় চেতনাকে এনে দিয়েছে এক অমিয় স্বচ্ছতা। রাজনৈতিক চেতনায় এবং অধিকারবোধে একুশই আমাদেরকে করেছে সচেতন, সক্রিয় ও প্রগতিশীল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে উঠতে পেরেছি আমরা। আমাদের স্বতন্ত্র্য সংস্কৃতির বিকাশেও একুশ ছড়িয়েছে উদ্দীপনা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এই কালজয়ী গানটি আমাদের নিজস্বতার এক অনন্য পরিচায়ক।

১৯৫৩ সাল থেকে এই দিনটিতে কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য, সমবেত কণ্ঠে একুশের গান, শহীদ মিনারের মনভোলনো আল্পনা- এসব বাঙালির জাতীয় চেতনায় এক নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে। একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্যের মাঠেও ফলিয়েছে অজস্র ফসল। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ সেই সাথে একুশের পটভূমিতে রাজবন্দি মুনীর চৌধুরীর লেখা কবর নাটকটি বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্দীপনায় প্রেরণার আগুন জ্বালিয়েছে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা ও বিকাশে ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা একুশের সাংস্কৃতিক চেতনারই অসামান্য।

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ইতিহাসের একটি বিশেষ দিন নয়। একুশ একটি চেতনার নাম। যে চেতনার বিশেষ দিকটি ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও এর বিস্তার। কিন্তু বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির হাতেই বাংলা ভাষা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ও অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে ইংরেজী সহ বিদেশী ভাষার দখলদারিত্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের দারুন প্রভাবও আমাদের মানসিকতায় বিদেশিয়ানার প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে। আসলে আমরা যেন ভুলেই যেতে বসেছি যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মাতৃভাষার উন্নতির অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে। আমরা মনে রাখতে পারি না, বাঙালির পরিচয়ের মূলভিত্তি তার ভাষিক পরিচয়।

একুশের পথ ধরেই এসেছে বাঙালির স্বাধীনতা। একুশের চেতনাই আমাদের জাতীয় জীবনে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের প্রেরণা যুগিয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিবিজড়িত এই একুশ শুধুমাত্র ইতিহাসের একটি রক্ত-রঙিন দিন নয়, এটি এখন “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” নামের একটি বিশ্ব-বিস্তৃত চেতনার নাম। আর আমাদের জন্য এ এক অসামান্য গৌরব আর আজন্ম প্রেরণা।

ফেব্রয়ারি ০১.২০২৩ at ১০:০৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর