আজ ৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস

ছবি: সংগৃহীত

আজ ৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার ১০ দিন পূর্বে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছর মার্চ মাসে মুজিব বর্ষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সফরের সময়ই ৬ ডিসেম্বর মৈত্রী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর।

আরো পড়ুন:
>পাইকগাছায় এসিল্যান্ড হিসেবে আরাফাত হোসেন এর যোগদান
>ছাত্রলীগের সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে পত্র লিখলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। অন্যদিকে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধবিরতিসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপন করল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই সারা বাংলাদেশের আকাশে সবুজের মাঝে লাল সূর্যের পতাকাটি পতপত করে উড়বে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তকে প্রতিহত করতে এগিয়ে এলো আমাদের আরেক বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন।

নিরাপত্তা পরিষদে দেশটি ভেটো প্রয়োগ করল। পাকিস্তানের হীন উদ্দেশ্য আর চরিতার্থ করা হলো না। এই ব্যর্থতা ঢাকতে যুক্তরাষ্ট্র অন্য পথ বেছে নিল। পাকিস্তানের পক্ষে এবার সে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একই ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন করল। ভোটাভুটিতে পাকিস্তান ১০৪ ভোট পেল এবং বিপক্ষে পড়ল মাত্র ১১ ভোট। যেহেতু সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত কোনো রাষ্ট্র মেনে নিতে বাধ্য নয়, তাই ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের নেতারা ওই সিদ্ধান্তকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, সামনে একটা পথই খোলা ছিল, দেশকে যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করা। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের ওই ষড়যন্ত্র স্বাধীনতার জন্য আমাদের চলমান যুদ্ধকে আরো তীব্রতর করে তোলে। তখন প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোনো না কোনো এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা রাতের আঁধারে পলায়ন শুরু করে দিয়েছে।

অর্থাৎ আমেরিকার শত চেষ্টায়ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে আলাপ-আলোচনায় যাওয়ার আর কোনো অবকাশ পায়নি। বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধ এবং বিশ্ব পরিস্থিতির সার্বিক বিবেচনায় ৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় ভারতের লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে ভারত সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। শ্রীমতী গান্ধী সেদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পত্র মারফত ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি জানিয়ে দেন।

সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সরাসরি সমর্থন ও সহযোগিতা করা ভারতের জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এর ১০ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ দখলমুক্ত হয়। ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই ১৮ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দুই দেশের মানুষের রক্ত, ত্যাগ ও দৃঢ় অঙ্গীকারের ঐক্যের শক্তি বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের দখল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

ভারতের সেনাদের সেই আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতাকে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিল। অন্যদিকে ভারতের জনগণ বাংলাদেশ ত্যাগ করে সে দেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল তার কোনো প্রতিদান হয় না। ভারতের সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অবদান আমাদের মনে চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে। তাঁর সেই অবদান বাঙালি জাতি কখনো ভুলে যেতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের শিকড় সেদিনই গ্রথিত হয় যেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনের শিকার হয়ে বাঙালিরা ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।

সেদিনই ভারতের জনগণ ও তাদের সরকার বাংলাদেশকে অলিখিতভাবে স্বীকার করে নেয়। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালিদের চরম দুর্দিনে ভারতের সরকার ও জনগণ একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত বাঙালিদের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রীর এই বন্ধন আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের কঠিন দিনগুলো থেকে উদ্ভূত। এই বন্ধন শুধু দুটি দেশকেই নয়, দুই দেশের জনগণকে একত্র করেছিল।

পারস্পরিক বিশ্বাস, সমঝোতা ও শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সম্পর্ক। দুই দেশের বীর শহীদদের মিশ্রিত রক্তধারার ওপর নির্মিত সে এক চিরস্থায়ী সম্পর্ক। তাইতো ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা সফরকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই এটিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। রক্ত দিয়ে গড়া সেই মৈত্রীর ভিত্তি পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক শক্তিশালী, গভীর ও সম্প্রসারিত করে। সৎ প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যেতে থাকে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বনে যায়।

এমনকি পাকিস্তানি মানসিকতায় চালিত সে সময়ের বাংলাদেশের সরকারগুলো ভারতবিরোধী নানা প্রচারণায় মেতে ওঠে। দুই দেশের মধ্যে সেই সময়ের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবস্থান থেকে সহজেই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। যা হোক, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করে। মাঝে পাঁচ বছর বিএনপি সরকার দেশ চালায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আবার শীতল হয়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর দুই দেশের সম্পর্ক মূলধারায় ফিরে আসে।

তখন থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের স্বার্থে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে একে অপরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে, নির্ধারিত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলছে এবং তাদের সম্পর্ক প্রতিদিনই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। মূলত দুই দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য সম্পর্ককে আরো জোরদার, কল্যাণমুখী ও নিবিড় করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের নেতারা আন্তরিকতার সঙ্গে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গত বছর মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর মৈত্রী দিবস পালনের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সূত্রপাত হয়েছিল, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার এই সুযোগটি করে দেওয়ার জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। ৬ ডিসেম্বর এখন আর বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের দিন হিসেবেই রইল না, এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেল দুই দেশের জনগণের মধ্যে লালিত এত দিনের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে, ওই দিনকে ‘মৈত্রী দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে। জয়তু মৈত্রী দিবস।

আর সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, গত বছর এই দিনে প্রথমবার ঢাকা ও দিল্লিতে দিবসটি পালিত হওয়া ছাড়াও একই সঙ্গে বিশ্বের ১৮টি দেশে বাংলাদেশ ও ভারতের দূতাবাসগুলো যৌথভাবে এই দিবসটি পালন করে। আজকে মৈত্রী দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে আসুন, আমরা একাত্তরের চেতনায় আবার প্রতিজ্ঞা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ একসঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ব, আমাদের উভয়ের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখব, একে অপরের সমস্যা বন্ধুত্বের অনুভূতিতে সমাধান করব এবং কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে দুটি দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।

ডিসেম্বর ০৬, ২০২২ at ১৬:০৫:০০(GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ/ইমস