সিলেট আর সুনামগঞ্জে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

সিলেট আর সুনামগঞ্জ এখন এক অচেনা নগর, অচেনা শহর। বিদ্যুৎ নেই, রাত নামলেই ঘুটঘুটে আঁধার চারদিক। চারপাশে পানি খেলা করলেও নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি। চলছে খাবারের মহাসংকট। রেলপথ, সড়কপথ, আকাশপথ- সব পথেই বানের বাগড়া। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোন, ধুঁকছে নেটওয়ার্ক। বানের পানিতে সিলেট অঞ্চলের অন্তত অর্ধকোটি মানুষ বন্দি। উপদ্রুত অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী। তবে বিপন্ন মানুষের জন্য সরকারের ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল। সহায়সম্বল সব হারিয়ে বহু মানুষের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। চিকিৎসাসেবায় ঘটেছে বিঘ্ন।

সবচেয়ে দুর্বিপাকে সুনামগঞ্জ। পুরো জেলা ডুবে থাকায় প্রকৃত খবর জানার মাধ্যমগুলো স্তিমিত হয়ে আসছে। মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ তাদের দুর্ভোগের কথা জানাতে পারছে না কাউকে। এতে দেশের অন্য প্রান্ত ও বিদেশে থাকা স্বজনরা সময় কাটাচ্ছেন উৎকণ্ঠায়। সরকারের জরুরি পরিষেবাও অনেকটা অচল। কয়েকটি স্থানে ইউএনও, ওসিসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনও কাজ করছে না। বন্ধ হয়ে গেছে ট্রেন ও বাস চলাচল। উড়ছে না উড়োজাহাজও। একমাত্র সম্বল নৌকা ভাড়া হয়েছে ১০ থেকে ২০ গুণ।

সুনামগঞ্জে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকিং সেবা। সিলেটেও তা বন্ধ হওয়ার পথে। মানুষ সিলেট ও সুনামগঞ্জ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় সেটাও এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্থানে মাঝারি থেকে ভারি, কোথাও অতিভারি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ দেশের বড় নদীগুলোতে পানি বাড়তে পারে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে যেতে পারে। এদিকে ঢাকায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ভাষ্য, আগামীকাল সোমবার থেকে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে উত্তরাঞ্চলে আরও তিন থেকে চার দিন পানি বাড়তে থাকবে।

সিলেট বিভাগের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এর আগে প্লাবিত এলাকায়ও বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সুরমা নদীর পর কুশিয়ারা নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জসহ আশপাশ এলাকায় নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত রয়েছে।

সিলেট বিভাগের চার জেলায় ভয়াবহ বন্যায় ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেক উপজেলায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর পর নৌ ও বিমানবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া কোস্টগার্ডকেও ডেকে পাঠানো হয়েছে উপদ্রুত এলাকায় উদ্ধার অভিযানে সহযোগিতার জন্য।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনসহ সংলগ্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় সরাসরি ট্রেন যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। কুমারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রিড উপকেন্দ্রসহ বিদ্যুৎ স্থাপনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পুরো নগরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। দু’দিন ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ার পর এবার তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। এদিকে, কদমতলীতে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পানি ওঠায় যে কোনো সময় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শনিবার ভারি বর্ষণে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

নগরীতে সকালে টানা বর্ষণে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর হাজারো মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছোটে। দুপুরে বৃষ্টিপাত সাময়িক বন্ধ হলে শত শত নারী-পুরুষ-শিশুকে সামান্য কাপড়চোপড় নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে দেখা গেছে। পরিবহন নেতা আবদুল গফুর জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের পর সিলেট জেলার সবকটি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা-সিলেটসহ দূরপাল্লার বাস এখনও চলছে। তবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে যে কোনো সময় তা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি জানান, পরিবহন সেক্টরের অনেকের বাড়িঘর প্লাবিত।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় চিকিৎসাসেবাও বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষ করে আইসিইউ ও অপারেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাসেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের বিশেষ জেনারেটরটি আনার চেষ্টা চলছে। হাসপাতালের নিচতলায় পানি ওঠায় নিজস্ব জেনারেটর চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে একই পরিস্থিতি হওয়ায় রোগী ও স্বজনরা বিড়ম্বনায় পড়েছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য নগরীর হোটেল-রেস্টুরেন্টের সিংহভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সিলেট নগরীর সুরমা নদীতীরবর্তী সবক’টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ শহরসহ সদর উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হতে শুরু করেছে। মৌলভীবাজারেও ব্যাপক বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জানান, সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নতুন নতুন উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াচ্ছি।

আরো পড়ুন :
গাইবান্ধায় জেলা ট্রাফিক বিভাগের বর্ণাঢ্য র‌্যালি
ঈদ-উল-আয্হা উপলক্ষে ১৫ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে ইবি

তিনি বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় প্রচুর সংখ্যক মানুষ উদ্ধারের অপেক্ষায় আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মাধ্যমে সমন্বয় করে তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জফির সেতুর বাড়ি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়।

সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলার শতভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। অন্যান্য উপজেলারও ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি। হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট বন্ধ থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছে মানুষ। শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ শহরতলির হাছনবাহারে গিয়ে দেখা গেছে, ২০০ পরিবারের একটি পরিবারও গ্রামে নেই। গ্রামের বেশিরভাগ ঘরের চাল ছুঁয়েছে পানি। গ্রামের সবাই শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। শহরতলি এবং শহরের বানভাসি মানুষ অন্যের ভবনের তালা ভেঙেও ভেতরে ঢুকছে আশ্রয়ের জন্য। তবে শুকনো খাবার বা কোনো প্রকার খাবারই পাওয়া যাচ্ছে না।

পানি উঠে যাওয়ায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। কোনো দোকান খোলা দেখলেই বানভাসি অসংখ্য মানুষ ভিড় করছে। দোকানের মালপত্র কেউ কেউ টাকা-পয়সা দিয়ে নিচ্ছে; আবার কেউ কেউ জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়ের জন্য নৌকা দেখলেই চিৎকার করে ডাকছে। ছোট ছোট বারকি নৌকা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি ও মারধরের ঘটনাও ঘটছে। আশ্রয়কেন্দ্রেও অনেকটা অনাহারে আছে মানুষ।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা দু’দিনের বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ির উঠান, বসতবাড়ি, দোকানপাট, গোয়ালঘর, ধানের গোলাঘরসহ বিভিন্ন জায়গায় পানি প্রবেশ করেছে। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে শুরু করেছে।

জুন ১৯,২০২২ at ১৫:৫৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/রানি/রারি