নতুন ইসির অগ্নিপরীক্ষা আজ

সব প্রস্তুতি শেষ, এখন শুধুই ভোটগ্রহণের অপেক্ষা। আজ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন। সবকিছু ঠিক থাকলে সকাল ৮টায় শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। একই সঙ্গে আজ দেশের ১৪১টি ইউনিয়ন পরিষদ, পাঁচ পৌরসভা ও চার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট হবে।

এ নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়েছে। চলতি বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসির এটিই প্রথম নির্বাচন। কোনো বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে এই ইসির অধীনেই হবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। ফলে নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা কতটা প্রস্তুত তার প্রথম পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে এই ইসি।

ভোটগ্রহণের আগমুহূর্তে প্রার্থী, প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক এবং ভোটারদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে এ নির্বাচনকে নতুন ইসির ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ছোট কিন্তু ইসির চ্যালেঞ্জ বড়। গত দুই কমিশনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, নির্বাচনের প্রতি অনীহা দূর করাই প্রথম কাজ। যেহেতু এই ইসির অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে এবং আগের দুটি কমিশন বিতর্কিত হয়েছে তাই নতুন কমিশনের ওপর চাপ বেশি। আবার ইভিএমে নির্বাচন ইস্যুতেও চ্যালেঞ্জ অনেক। কারণ ইভিএমের ওপর বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলেরই আস্থা নেই। নতুন ইসির জন্য এ নির্বাচন একটি ‘এসিড টেস্ট’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আউয়াল কমিশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই ব্যর্থ হয়েছে। কুমিল্লার একজন এমপিকে (সংসদ সদস্য) তারা এলাকা ছাড়ার নোটিস দিলেও সেটি কার্যকর করতে পারেনি। তাহলে ইসির সমক্ষমতা কোথায়?

সংসদের বাইরের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে, সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ ইসি নিয়ে তারা ভাবছে না। আর একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বা সামর্থ্য পরীক্ষা হয় না। তারপরও শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে ইসি। একজন এমপির বিষয়ে যে ইসি সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছপা হয়, সেই ইসি কীভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে?

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, ইসির কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রভাবই নেই। নতুন ইসির জন্য অবশ্যই এই নির্বাচন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন সিইসি একজন এমপিকেই এলাকা থেকে সরাতে পারেননি। এই ইসিকে দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না, আমরা আগেই বলেছি। সরকারের দিক থেকেও সিইসিকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। আর বিএনপি আগের সিদ্ধান্তেই রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাব না। কাজেই আমরা এ নির্বাচন নিয়ে ভাবছিই না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যেহেতু আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না সেহেতু ইসির ভূমিকা নিয়ে আমরা ভাবছি না।’

কুমিল্লার এক এমপিকে নোটিস দিয়ে এলাকা থেকে সরাতে চাওয়ার বিষয়টির সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কোনো সংসদ সদস্যকে নিজ নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলা তার মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমার প্রশ্ন হচ্ছে যিনি ওই এলাকার সংসদ সদস্য, ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, যিনি ওই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটার, তাকে নির্বাচন কমিশন এলাকা ছাড়ার কথা বলতে পারে কি না। এটি কি তার মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ নয়? তাহলে তো ঢাকা শহরে যখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে তখন ঢাকা থেকে নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য, মন্ত্রীদেরও ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।’

ড. হাছান মাহমুদ আরও বলেন, ‘এভাবে তাকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে তার মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনি যাতে কোনো নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা বা নির্বাচনী কর্মকা-ে অংশগ্রহণ না করেন, সেটির নির্দেশনা অবশ্যই থাকবে, থাকা বাঞ্ছনীয় এবং সেটি করলে অন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু যিনি ওখানে ভোটার ওই এলাকার সংসদ সদস্য তাকে নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা কি সমীচীন হয়েছে, সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন?’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইসি পরীক্ষার আগেই ব্যর্থ হয়েছে। তারা একজন সংসদ সদস্যকেই নির্বাচনী বিধি মানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে ৩০০ এমপি থাকবেন, বিরোধী দলগুলোর প্রার্থী থাকবেন এবং তাদের কর্মী-সমর্থক থাকবেন। তাহলে ৩০০ আসন কীভাবে সামলাবে এই ইসি। ইভিএমের বিষয়টি মেশিনের বিষয়। আবার প্রিন্ট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় এটি অনেক দেশই গ্রহণ করেনি। আর একটি নির্বাচনে বিশেষ করে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠানেই ইসির হোঁচট খাওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’

এদিকে গতকালও সিইসি ও অন্য নির্বাচনী কমিশনার বলেছেন, তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েছেন।

আরও পড়ুন:
সিএনজি পাম্প রাস্তাটি ময়লা পানি মুক্ত হলো
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গরম পানি পান করুন, নানা সমস্যার ওষুধ

এ দফায় ঝিনাইদহ পৌর নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে আউয়াল কমিশন। এছাড়া ওসি প্রত্যাহার, বিভিন্ন প্রার্থীর নামে মামলা, ভোট স্থগিতএমন সিদ্ধান্তে কমিশন নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ পর্যবেক্ষক, এমনকি সাধারণ মানুষের খানিকটা আস্থা কুড়িয়েছে। তবে কুমিল্লা-৬ আসনের এমপির নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, তাকে সতর্ক করে ইসির চিঠি এবং সংসদ সদস্যের তা তোয়াক্কা না করা নিয়ে কমিশনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কমিশন।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, কুসিক ভোট পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে থাকবেন ৯২ জন। সাতটি সংস্থার আওতায় তারা ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন। ইসি সচিবালয়ের জনসংযোগ শাখা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তারা জানান, এই সিটি ভোট পর্যবেক্ষণে কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক আবেদন করেননি। দেশি সাতটি সংগঠনের ৯২ পর্যবেক্ষককে ভোট পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ইসি জানায়, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) ৬, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের ১৩, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার ৬, রিহাফ ফাউন্ডেশনের ২৭, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশনের ২৭, মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থার (মওসুস) ৫ ও সমাজ উন্নয়ন প্রয়াসের ৫ পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুসারে ইসি গঠনে ১০ জনের নাম সুপারিশের জন্য গত ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। আইন অনুযায়ী কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেন সার্চ কমিটির সদস্যরা। সেখান থেকে ৫ জনকে নিয়ে ইসি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ২৬ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও অন্য চার কমিশনার নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরদিন শপথ নেন সিইসি অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং চার কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান।

জুন ১৫,২০২২ at ০৬:৩০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেরু/রারি