ইউক্রেনে রুশ অভিযান: ‘নিরপেক্ষ’ কেন বাংলাদেশ

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ কার পক্ষে থাকবে- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরই ফেসবুকে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের ভিডিও ভাইরাল করা হয়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থনের কারণে তাদের মোবারকবাদ জানালেও বঙ্গবন্ধু নিজেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দেয়া পররাষ্ট্র নীতি অনুযায়ী, ‘কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এই স্লোগানকে ধারণ করেই বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানেও বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর দেয়া পররাষ্ট্রনীতি মেনেই কাজ চালাচ্ছে।

তবুও প্রশ্ন উঠেছে, রাশিয়ার সামরিক অভিযানে বাংলাদেশ কার পক্ষে রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমরা নিরপেক্ষ। আর কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এমন প্রশ্নের জবাব পেতে আরো কদিন অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি রাশিয়ার সরকার, রাশিয়ার জাতিকে ধন্যবাদ জানাই। না জানালে অন্যায় হবে। যখন সাম্রাজ্যবাদীশক্তি চেয়েছিল এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী থাকবে, সামরিক ঘাঁটি থাকবে, কিন্তু রাশিয়ার ভেটোতে থাকতে পারে নাই। সেজন্য আমি রাশিয়াকে মোবারকবাদ জানাই।’

বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনীতিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে থাকতে চায় না বাংলাদেশ। ভারসাম্যের নীতি বজায় রেখেই বিশ্বের আরো ৩৭টি দেশের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জাতিসংঘে ভোট দেয়নি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতি সম্প্রতি যে সব প্রস্তাব জাতিসংঘে এসেছে, সেই সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিবেশী ভারত, চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতোই ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ। তারা এও বলেছেন, ভোট দান থেকে বিরত থাকলেই প্রমাণ করে না বাংলাদেশ কারো পক্ষে চলে গেল? তবে বিভিন্ন দেশ এটা নিয়ে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করবে। কেন ভোটদানে বিরত ছিল তা বাংলাদেশের বলা উচিত ছিল।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে মোমেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে সেখানকার বাঙালিদের সংবাদ প্রতিষ্ঠান ইউএসএ অনলাইন জার্নালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধের কোনো এক পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপরে ব্যাপক চাপ রয়েছে। তবুও আমরা কোনো পক্ষেই যোগ দিচ্ছি না। কারণ আমাদের একটা নীতি আছে। সেই নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ কারো সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না।

বাংলাদেশ নিরপেক্ষ। বাংলাদেশ মনে করে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পুরো বিষয়ের সমাধান সম্ভব। আমরা সব রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, আমরা সেটাই চাই। তিনি জানান, ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে সবরকম যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। নিরপেক্ষ থাকা কি সহজ- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন- না, কোনোভাবেই নিরপেক্ষ থাকা সহজ নয়। আমরা ভীষণ চাপে আছি। তবু আমরা নীতি মেনে নিরপেক্ষ হয়ে চলছি। জানি না কতদিন এই নীতি মেনে চলতে পারব।

রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম গণমাধ্যমে বলেছেন, এটা এখনই বলা মুশকিল। যুদ্ধ থেকে অনেকেই বিরত থাকছে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আনা প্রস্তাবে নিন্দা জানানো উচিত ছিল। কারণ বাংলাদেশও আগ্রাসনের শিকার। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এখন কেন করেনি তার ব্যাখ্যা বাংলাদেশের দেয়া উচিত ছিল। ওই ব্যাখায়ই বেরিয়ে আসত বাংলাদেশ কেন নীরব বা নিরপেক্ষ থাকল। তবে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির কোনো পর্বে যাচ্ছে বাংলাদেশ- এমন প্রশ্নের জবাবে এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আমরা দরকষাকষি করলাম না পিছিয়ে গেলাম তার উত্তর সময় দেবে।

একই প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশ কোনদিকে তা বলার অধিকার সম্পূর্ণ সরকারের। কি বলবে তা সরকারের চিন্তার প্রতিফলন। তবে আমি মনে করি, জাতিসংঘের ‘প্রিন্সিপল এবং পারপাসেজকে ভিত্তি করে জাতিসংঘে কেন ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ- তা জোরালো ও শক্ত বিবৃতির মধ্য দিয়ে জানানো উচিত ছিল। যেরকম অনেক সদস্য রাষ্ট্রই কেন ভোটদানে বিরত ছিল, তার ব্যাখা দিয়েছে, এরমধ্যে ভারতও রয়েছে। তিনি বলেন, এটাও ভাবতে হবে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং সে হিসেবে একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকা দরকার। এ কারণে বাংলাদেশের আর একটু কৌশলী হয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের প্রতি জাতিসংঘ সনদ, জেনেভা কনভেনশন এবং মানবাধিকার সদনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানানো উচিত। কারণ এসব সনদ অনুযায়ী একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে গায়ের জোরে হামলা চালানো যায় না। আজ বঙ্গবন্ধু থাকলে নিশ্চিত তিনি আগ্রাসনের বিপক্ষে ভোট দিতেন।

তবে অন্য কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এখন বিশ্বরাজনীতির পরিস্থিতি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিকর। চীন ও ভারত সরাসরি কারো পক্ষে না যাওয়ার কারণে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে পারছে।

যদি চীন সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চলে যেত, তাহলে বাংলাদেশের সামনে বড় একটা কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ চলে আসত। তখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো বাংলাদেশকে। তবে সে অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই বাংলাদেশের সামনে ইউক্রেন যুদ্ধ কী পরিস্থিতি নিয়ে আসছে তা জানতে আরো সময় লাগতে পারে। কারণ ভোটদান থেকে বিরত থাকার মানে একেক দেশ একেকভাবে নেবে। ভোটদান থেকে বিরত থাকার ফলে যুক্তরাষ্ট্র একভাবে বিশ্লেষণ করবে, আবার চীন অন্যভাবে করবে।

জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ জমির বলেছেন, বাংলাদেশ কেন ভোটদানে বিরত ছিল তা এখনই বলা ঠিক হবে না। কারণ ‘কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এই নীতি নিয়েই আমরা চলছি। তবুও আমরা রাশিয়াকে বলেছি, তোমাদের এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না, যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে তিনি বাংলাদেশ নিরপেক্ষ না কোনো দিকে ঝুঁকছে তা জানতে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহায়তা দানকারী। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর বাণিজ্য ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৮৪ ডলার। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে রাশিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। একদিকে তৈরি পোশাকের রপ্তানির বাজারে প্রভাব পড়লে বাংলাদেশকে যেমন সংকটে পড়তে হবে, অন্যদিকে মেগা প্রকল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেও সংকটের সৃষ্টি করবে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এবং বিদেশের শ্রমবাজার অস্থিতিশীল হলে সেটাও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এজন্য বাংলাদেশ খুব হিসাব কষে সামনে এগুচ্ছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ কেন নিরপেক্ষ তা জানতে হলে পররাষ্ট্র নীতি জানতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির যে বৈশিষ্ট্য সেটিই এখানে সরকার বজায় রাখছে। আর ঠিক একারণেই বাংলাদেশ কোনো পক্ষে যোগ দেয়নি। শুরু থেকেই আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

মার্চ ০৫, ২০২২ at ১২:১১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/বিকে/তআ