আ.লীগের কেন্দ্রীয় সভায় উঠে এলো তৃণমূলে কোন্দলের চিত্র

প্রায় ১১ মাস পর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টে উঠে এসেছে দলটির সারাদেশের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ভয়াবহ চিত্র। এ সময় নিজ এলাকার সমস্যা নিয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন নেতাদের কেউ কেউ। সব শুনে তৃণমূলের যাবতীয় কোন্দল দ্রুত সমাধানের নির্দেশনা দিয়েছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আর কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাশত না করার ব্যাপারেও কঠোর বার্তা দেন তিনি। সভায় এখন থেকেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান।

গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এই সভা। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলা এ সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের ৫৩ জন সদস্য এতে অংশ নেন। শুরুতেই সূচনা বক্তব্য রাখেন দলীয় প্রধান।

এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। তারপরই ৮ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা স্ব স্ব বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট তুলে ধরেন। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশে না থাকায় রিপোর্ট পেশ করেন ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন সিলেট বিভাগ, বি এম মোজাম্মেল হক খুলনা বিভাগ, এস এম কামাল হোসেন রাজশাহী বিভাগ, মির্জা আজম ঢাকা বিভাগ, সাখাওয়াত হোসেন সফিক রংপুর বিভাগ, এডভোকেট আফজাল হোসেন বরিশাল বিভাগ এবং সফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ময়মনসিংহ বিভাগের রিপোর্ট পেশ করেন। তারা বিভিন্ন জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের চিত্র তুলে ধরেন। পরে সভার বিষয়বস্তু নিয়ে বিকালে গণভবনের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সভাসূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর, নাটোর, পাবনা ও নরসিংদী জেলার সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এ সময় মাদারীপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় চারজন নেতা অনেকটা তর্কে জড়িয়ে পড়েন। নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও বেশকিছু অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

শাজাহান-নাছিম-গোলাপের বাহাস : বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করার একপর্যায়ে মাদারীপুরের প্রসঙ্গ তুলে ধরার পর শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিন নাছিমের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এ সময় মির্জা আজম কালকিনি উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুটি কমিটির কথা তুলে ধরে বলেন, সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ একজন দায়িত্বশীল নেতা হয়ে নিজের মতো করে একটি কমিটি দিয়েছেন। আরেকটি কমিটি দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে সেখানে বিরোধ চলছে। অথচ সেখানে শাজাহান খানসহ বড় বড় নেতারা আছেন। এ সময় উপস্থিত আব্দুস সোবহান গোলাপ ফ্লোর নিয়ে বলেন, ‘সেখানে কমিটির বিষয়ে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং একজন কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার পরও আমাকে সেখানে হেয় করে কথা বলা হয়।’ তখন প্রধানমন্ত্রী গোলাপের পক্ষ নিয়ে মির্জা আজমকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি কথা এভাবে ঘুরিয়ে বললে কেন, তোমার উপস্থাপন তো ঠিক হয়নি।’

এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান তার এলাকার সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তাকে কাউন্টার দেয়ার জন্য বাহাউদ্দিন নাছিমও দলীয় সভাপতির অনুমতি নিয়ে কথা বলেন। শাজাহান খান বলেন, ‘মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি হলে কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে যান। অথচ আমাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তারা আমার সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেন না।’ প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ‘ঠিকই তো, আপনাকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হবে না।’ এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম শাজাহান খানের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ‘তিনি এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য যা যা করার তাই করে চলেছেন। তিনি এখনো আওয়ামী লীগার হতে পারেননি। জাসদ আর কিছু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এলাকায় দাপট দেখিয়ে চলেছেন। দলের নেতাকর্মীদের পাত্তা দেন না। প্রবীণ আওয়ামী লীগাররা সেখানে অবহেলিত। কেউ মারা গেলে একটা দোয়া মাহফিল বা স্মরণসভাও তিনি করেন না।’

এরপর শাজাহান খান নাছিমের কথার জবাব দিলে কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। পরে প্রধানমন্ত্রী শাজাহান খানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি আওয়ামী লীগ হওয়ার চেষ্টা করেন। এ পার্টিতে আপনারও অবদান আছে। আওয়ামী লীগে আসার আগেও যখন জাসদ করতেন, তখনো আপনি আমার কথা শুনেছেন।’ শাজাহান খানও তার বাবা, স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ করতেন- ইত্যাদি আবেগী কথা বলা শুরু করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শাজাহান খানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি সবার সিনিয়র। নাছিম, গোলাপসহ যারা আছেন, সবাইকে ছোট ভাইয়ের মতো করে দেখে রাখবেন। একসঙ্গে চলবেন।’ পরে তিনি শাজাহান খান আর বাহাউদ্দিন নাছিমকে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেন।

নাটোরের সভাপতি-সম্পাদকের ক্ষুব্ধ শেখ হাসিনা : সভায় নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন শেখ হাসিনা। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধ চরমে থাকায় জেলার কোনো ইউনিটেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে না। দলীয় প্রধান সেখানে দ্রুত সম্মেলন করার নির্দেশ দেন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাড়াবাড়ি কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনা দেন।

এ সময় শিমুল সম্পর্কে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। এমনকি একপর্যায়ে নিজের মোবাইলে থাকা তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘শিমুলের চলাফেরা, তাকে নিয়ে এত লেখালেখি ছাড়াও নানা অপকর্মে সে জড়িয়ে পড়েছে। এত বাড়াবাড়ি ঠিক না। আসলে অল্প বয়সে এত ভারী পদপদবি বহন করতে পারছে না।’ পরে শিমুলের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন এবং তাকে চাপে রাখার নির্দেশ দেন তিনি।

এছাড়া নরসিংদী, লালমনিরহাট, সৈয়দপুরসহ অন্যান্য এলাকার বিদ্যমান সমস্যা নিয়েও অভিযোগ তুলে ধরেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা।

একই ব্যক্তি সহযোগী সংগঠন ও মূল দলে থাকতে পারবে না : উপস্থিত একজন সাংগঠনিক সম্পাদক দলীয় প্রধানের উদ্দেশে বলেন, কমিটি করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তি সহযোগী সংগঠন যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিরও নেতা আবার তিনি আওয়ামী লীগেরও নেতা হচ্ছেন। এটা অতীতে আমাদের দলে ছিল না। একই ব্যক্তি সহযোগী সংগঠন আর মূল দল আওয়ামী লীগে থাকলে সেটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। এদের নেতা বানানোর জন্য আবার অনেকেই আমাদের চাপ সৃষ্টি করেন, সুপারিশ করেন। এরপর দলীয় নেত্রী গঠনতন্ত্র মোতাবেক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এটা তো হওয়ার কথা নয়। কেউ মূল দলে থাকলে, অন্য সহযোগী সংগঠনে থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে তিনি সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন।

পাবনায় নৌকার বিরোধিতাকারী ২০ নেতা ক্ষমা পেলেন : পাবনা পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়েছেন শরীফ প্রধান। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। এর আগেই ক্ষমা চেয়ে দলীয় প্রধানের কাছে চিঠি দিয়েছেন মেয়রসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের ২০ নেতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আবার উনি এটাও বলেছেন, যারা দলের ডিসিপ্লিনের বাইরে কাজ করেছেন, বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ব্যাপারে ছাড় দেয়া যাবে না।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশনা : সভা শেষে বিকালে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, সভায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলীয় সভাপতি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নেরও নির্দেশনা দিয়েছেন। বিভিন্ন উপকমিটিগুলোর সেমিনারের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনের যে ইশতেহার হবে, সেখানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে; সেগুলো আপডেট করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন- স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আমরা কী কী অন্তর্ভুক্ত করব তা তুলে ধরা হবে।

আরো পড়ুন :
মঙ্গলগ্রহে জমি কিনলেন লালমনিরহাটের প্রকৌশলী এলাহান!
পাটগ্রামে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত ছেলে, গুরুতর আহত মা

তিনি বলেন, সভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের নেতারা তাদের এলাকার ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত রাজনৈতিক চিত্র কী তা জানিয়ে রিপোর্ট উত্থাপন করেছেন নেত্রীর সামনে। যেখানে যেখানে সাংগঠনিক সমস্যা আছে এবং যেগুলো সমাধান করা দরকার, সেগুলোর ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। কিছু কিছু ছোটখাটো কলহ-বিবাদ আছে, সেগুলোও মীমাংসার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ততই অপপ্রচারের মাত্রা বাড়ছে। এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে। চক্রান্তমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়তে হবে।

সেপ্টেম্বর  ১০.২০২১ at ১৪:৩০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি