ঘরবন্দি জীবনে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা

ছবি : প্রতিকি

আব্দুল আজিজ ও মো. আসাদ দুই ভাই রাজধানীর চকবাজারের হোসেনী দালান এলাকার বাসিন্দা। সেখানে ‘আসাদ নাশতা ঘর’ নামে তাদের একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল। বড় ভাই আব্দুল আজিজকে খুব ভালোবাসতেন ছোট ভাই আসাদ। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত বড় ভাই মারা যাবেন- এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না আসাদ।

এ নিয়ে তার মধ্যে হতাশা কাজ করছিল। গত রোববার সকালে আজিজ রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মারা গেলে বাবুবাজার ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন আসাদ।

ঘুষ দিয়েও ছেলের চাকরি না হওয়ায় গত ১৯ আগস্ট চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হালিমপুরের পাঁচআনি গ্রামে এমদাদুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রিয় সন্তানের ব্যাংকে চাকরি হবে- এমন প্রলোভনে পড়ে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন নিজেরই অফিস বসের হাতে। তিন বছরেও চাকরি হয়নি সন্তানের। ফিরে পাননি ১০ লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে চরম মানসিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন তিনি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

এ দুটি ঘটনা ছাড়াও অপবাদ, অর্থনৈতিক সংকট, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশার কারণে করোনাকালে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটেছে। বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে গত এক বছরে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে দেশে আত্মহত্যার এমন চিত্র উঠে এসেছে।

গত ২১ আগস্ট দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর চয়নপাড়া গ্রামে প্রতিবেশী এক কৃষকের মুরগি চুরির অপবাদে আত্মহত্যা করে দশম শ্রেণির ছাত্র মোরসালিন।

এমন পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’। এ দিবসকে কেন্দ্র করে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন মনোবিশেষজ্ঞরা।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৯ সালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ টিমের প্রধান এএসএম শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, করোনাকালে মানুষ গৃহবন্দি থেকেছে। এ সময় মানুষের মধ্যে নানা কারণে হতাশা, বিষণ্ণতা বেড়েছে। যার নানামুখী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটাতে পারেন যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষ। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন।

প্রতি এক হাজার মৃত্যুর মধ্যে ১৩ জনই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আবার প্রতি ১০০টি আত্মহত্যা ঘটানো মানুষের মধ্যে ৫৮ জনের বয়সই ৫০ বছরের নিচে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বছরে প্রায় ছয়জন আত্মহত্যা করে থাকেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছেন। ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছেন। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। আবার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা করার হার দ্বিগুণ।

গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে পুরুষের চেয়ে বেশি নারী আত্মহত্যা করেছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ১৪ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা আট হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ছয় হাজার ২০৮টি।

করোনাকালে আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়, পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল বলেন, অনেক আত্মহত্যাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। যারা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই আগে থেকে বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। আশপাশের কারও মধ্যে আত্মহত্যা করার ইঙ্গিত পেলে তাকে দ্রুত সাহায্য করা এবং তার পাশে থাকলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব।

আরো পড়ুন :
পাখি মারা হাওরে লক্ষাধিক নারী পুরুষের সমাগমে নৌকা বাইচ উৎসব অনুষ্ঠিত
কেশবপুরে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে শিশু-কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া, আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমানো, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা, যে কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিকটজনকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সেপ্টেম্বর  ১০.২০২১ at ১২:৪০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সম/রারি