আতংকিত জনপদের আরেক নাম মগনামা!

ছবি : ফাইল

সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা। শিক্ষা,শান্তি,ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধে এক সময়ে পরিচিত ছিল মগনামা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন গুনীজন।দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছে অনেক মেধাবী ব্যক্তিরা। জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেক দেশবরন্য ব্যক্তিবর্গ। স্বাধীকার যুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

এ মগনামায় জন্ম নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সরকারের গভর্নর ও সাবেক সাংসদ প্রয়াত এড.জহিরুল ইসলাম, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ প্রয়াত মাহমুদুল করিম চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা প্রয়াত মেজর রুহুল আমিন চৌধুরী, দেশের নাম করা চিকিৎসক মাহবুব কামাল চৌধুরী, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত নজরুল ইসলাম চৌধুরী, পীরে কামেল মাওলানা জাফর আলমসহ অনেকে।

অন্য ইউনিয়ন থেকে মগনামা ইউনিয়ন ছিল আলাদা মর্যদায়। শান্তির বসবাস ছিল এক সময় প্রায় ৩৫ হাজার লোকের এ ইউনিয়ন। এখন সেই জুলুস হারিয়ে গেছে। খুন, চাঁদাবাজি, দখল বেদখল, অবৈধ অস্ত্রের মহড়া, লুটপাট, চুরি চামারিতে আলোচনা, সমালোচনায় এখন বেশ পরিচিত মগনামা ইউনিয়ন। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। পত্রিকা, শোস্যাল মিডিয়া, অনলাইন পত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখা যায় মগনামার কথা। প্রতিদিন কোন না কোন দুঃসংবাদ। মগনামা এখন টক অব দ্যা কক্সবাজার।

 

আতংকের একটি ইউনিয়নের মগনামা। সাধারন মানুষই মগনামা নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠে। গত কয়েক বছর ধরে মানুষের মাঝে অশান্তি বিরাজ করছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধিতা, বংশ, গোত্র বিরোধ, স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধিত্ব নেতৃত্ব, আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, মামলা নিয়ে হয়রানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, হাইব্রীডদের প্রধান্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চরম বিপর্যয়ে ঐতিহ্যবাহী এ মগনামা। ইয়াবা ও অস্ত্রধারীদের দৌরত্ম, কিশোর গ্যাং, টাইগার বাহিনীর অত্যাচারে ভাল নেই এই জনপদের জনগন।

এক সময় মগনামায় ইউনুস বাহিনী ও কানফুল বাহিনী নামে দুইটি বাহিনী ছিল। বর্তমানে ওয়াসিম বাহিনী ও টাইগার বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যদিও এসব বাহিনীর কোন অস্তিত্ব নেই বলে দাবী করেছেন ইউপির চেয়ারম্যান ওয়াসিম। এসব বাহিনী সাংবাদিকের সৃষ্টি বলে যুক্তিতর্ক করেন এসব বাহিনীর কয়েকজন লোক।

সম্প্রতি মগনামায় ছাত্রলীগ নেতার চিংড়িঘের থেকে মাছ লুটের ঘটনায় ইউপির চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ভাইকে পিটিয়ে জখমের ঘটনায় ও পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনতাই ও হামলার ঘটনায় পৃথক দুইটি মামলায় মানুষশুন্য মুহুরীপাড়া, মগঘোনা ও নুইন্যারপাড়া গ্রাম। গ্রেপ্তার আতংকে এসব মানুষ এলাকাছাড়া হয়েছে। গ্রাম তিনটির নারীরাও গ্রেপ্তার, হামলার আতংকে রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামীলীগের প্রবীন নেতা আব্দুল জলিল বলেন, বাড়িতে থাকা ছেলে আশেক বিন জলিলকে পুলিশের ওপর হামলার মামলায় আসামী করা হয়েছে। সে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।আওয়ামীলীগ করে বলে মামলার আসামি হয়েছে। অজ্ঞাতনামায় গ্রেপ্তারের ভয়ে অপর পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু নারী-শিশুরাই এখন ঘরে আছে।

মুহুরী পাড়ার বাসিন্দা সংবাদকর্মী মুহাম্মদ হাসেম বলেন, তার স্ত্রী, অসুস্থ ভাই, ভগ্নিপতি ও চট্টগ্রামে স্কুল কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলে মোহাম্মদ আরমান এবং মোহাম্মদ আরিফসহ পাঁচজনকে পুলিশের মামলায় আসামী করা হয়েছে। বাড়িতে কেউ নাই। ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

 

ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মুহুরী পাড়ার বাসিন্দা নাজেম উদ্দিন বলেন, প্রতি রাতেই পুলিশ ও ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াসিমের অনুসারীরা মুহুরী পাড়া ও মগঘোনার প্রতি ঘরে আসামী আটকের নামে তল্লাশি চালাচ্ছে।

পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মমতাজুল ইসলাম বলেন, আমি বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। পুলিশের ওপর হামলা ও ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ভাইদের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলায় আমাকে ১নং আসামী করা হয়েছে। আমার দুই ভাতিজাকে মিথ্যা ভাবে আসামী করা হয়েছে। পুলিশ টানা তিন রাত আমার বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের নারী শিশুসহ সকলেই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ চেয়ারম্যানের টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে।

আরো পড়ুন:
অবশেষে জামিন পেলেন পরী মনি
বেনাপোল রেলস্টেশন থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার

ইউনিয়নের নুন্নার পাড়ার বাসিন্দা আনসার সদস্য মোজাম্মেল খান বলেন, ছয়মাস পর ছুটিতে আমি বাড়ি এসেছি। পুলিশের ওপর হামলা ও ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ভাইদের ওপর হামলা মামলায় আসামী বানানো হয়েছে। এর আগেও জয়নাল হত্যাকান্ডে মামলা দিয়ে আমার বাপ-ভাইদের ঘর ছাড়া করেছে ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াসিম।

মগনামা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রুকন উদ্দিন বলেন, পরিবারের ছয়জনকে আসামি করেছে। স্ত্রী, ভাই,ভাবী,দুই বোন ভগ্নিপতিসহ পুলিশের ওপর হামলা মামলায় আসামী করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ভাইদের ওপর হামলার মামলায় আমাকে আসামি করে। ঘরে এখন মানুষ বলতে কেউ নেই। প্রতিদিন রাতে পুলিশ বাড়িতে এসে তান্ডব চালাচ্ছে।

 

মগনামা ৫ নং ওয়ার্ড আ’লীগের সহ-সভাপতি মো.সেলিম বলেন, পরিবারের চার সদস্যকে আসামি করে ক্ষান্ত হয়নি। রাতে পুলিশ তল্লাশির নামে তান্ডব চালাচ্ছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছাড়া সবাই।

মগনামা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খায়রুল এনাম বলেন, মাছ লুটের ঘটনায় বিএনপি নেতা চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ভাই এনায়েত ও মামাতো ভাই আরাফাতকে পিটুনি পিটুনি দেয় ঘেরের পাহারাদাররা। এ ঘটনাকে পুঁজি করে ওয়াসিমের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুহুরী পাড়া গ্রামে হামলা ভাংচুরের চেষ্টা চালায়। মাইকে ঢেকে সুসংগঠিত হয়ে গ্রামবাসীরা তা প্রতিহত করে। এসময় চেয়ারম্যান ওয়াসিমের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে মুহুরী পাড়া লোকজনের ওপর চড়াও হয়। কিন্তু পরে পুলিশ চেয়ারম্যান ওয়াসিমের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে। চেয়ারম্যান ওয়াসিমের ছোটভাই জুনাইদ ইশরাক বাবু বাদি হয়ে আরো একটি মামলা করে। সেখানেও নিরীহ ১৪ জন মানুষকে আসামী করা হয়েছে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম বলেন, মঙ্গলবার সকালে আমার ভাইদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীদের ধরতে গেলে মুহুরী পাড়ার কিছু বাসিন্দা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আর আমার ভাইদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অপরাধীদের আমি আইনের মাধ্যমে মোকাবেলা করছি। আমি বা আমার কোন লোকজন কাউকে আক্রমণ করিনি। কারোর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দেইনি। কিন্তু এবিষয়ে আমার প্রতিপক্ষের লোকজন অপপ্রচার চালাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত কানন সরকার জানায়, কোন নিরহ ব্যক্তি যদি তদন্তের মাধ্যমে চার্জশীট থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হবে।

আগস্ট ৩১.২০২১ at ১৬:২৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এজ/জআ