মুমিনের সম্মান : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মানুষের সম্মান ও মর্যাদা জন্মগত অধিকার। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে মুমিনের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচাইতে বেশি। একজন মুমিনের মান-মর্যাদা অপর মুমিনের কাছে আমনতস্বরূপ। ঈমানের শর্তসমূহ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। মুমিনগণ প্রতিটি কাজে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হন। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।’ (সুরা রূম, আয়াত-৪৭) মুমিনগণ যে কোনো বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা, যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৯) বিশ্বজাহানের কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নেই। সবকিছু তারাই মুখাপেক্ষী। আল্লাহতায়ালা বলেন, বলুন! হে আল্লাহ তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্যদান কর আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা কর অপমান। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমাতাশীল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-২৬)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, কেউ সম্মান চাইলে জেনে রাখুক, সমস্ত সম্মান আল্লাহরই জন্য।’ (সুরা ফাতির, আয়াত-১০)

মুমিনের সম্মান : আল্লাহতায়ালা মুমিনদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদাবান করেছেন। যারা ইহকালে ঈমান আনে এবং ঈমানের দাবি অনুসারে জীবন পরিচালনা করে তাদের জন্য পরকালে চিরস্থায়ী জান্নাতের ব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, আমরা যদি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সবলরা (সম্মানীরা) অবশ্যই দুর্বলকে (হীনদেরকে) বহিষ্কার করবে। শক্তি (সম্মান) তো আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুমিনদেরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানেনা।’ (সুরা মুনাফিকুন, আয়াত-৮) মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়পাত্র। আখিরাতে তাদেরকে চিরশান্তির স্থান জান্নাত দান করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে ফিরদাউস জান্নাত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত-১০৭, ১০৮)

হজরত জায়েদ ইবনে হারাম (রা.) ছিলেন মদিনার গ্রাম্য সাহাবি। তিনি নবীজির জন্য গ্রামের জিনিস নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি বাজারে আসলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরেন। এক পর্যায়ে নবীজি বললেন, আমি এই গোলামকে বিক্রি করব কেউ কিনবে? তখন তিনি নবীজিকে চিনতে পেরে বললেন, হে আল্লাহ রাসুল! আমাকে বেচে আপনি বেশি লাভ করতে পারবেন না। কারণ আমি কালো ও কুৎসিত। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে জায়েদ! তুমি সস্তা নও। তুমি ঈমানদার। তোমার প্রতিপালকের কাছে তুমি অনেক মূল্যবান।

মুমিনের সম্মান কাবা ঘরের চেয়েও বেশি : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা ঘর তাওয়াফ করছিলেন। তিনি (কাবাকে লক্ষ করে) বলেন, ওহে আল্লাহর ঘর তুমি কতই পবিত্র এবং তোমার সুঘ্রাণ কতই না মন-মাতানো! তুমি কতই না মর্যাদাবান, কত সম্মানের অধিকারী! নিশ্চয়ই সেই সত্তার শপথ যার হাতে মোহাম্মদ (সা.) এর প্রাণ! একজন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তোমার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান, তাদের মাল ও রক্ত। এজন্য আমরা মুমিনদের ব্যাপারে সর্বদা সুধারণা পোষণ করি।’ (ইবনে মাজাহ,২/১৮৩০)

মুমিনের সম্মান ফেরেশতার চেয়েও বেশি : আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ করে সৃষ্টি করেছেন। আদম সন্তানকে তিনি অন্যান্য সৃষ্টি জীবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি। তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনী-ইসরাইল, আয়াত-৭০)। ফেরেশতা, জীন, মানব ইত্যাদি আল্লাহর সৃষ্টি। জীনজাতির চেয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অনেক বেশি। আদম সন্তানের মধ্যে যারা পরিপূর্ণ মুমিন ওলি-আউলিয়া তাদের মর্যাদা সাধারণ ফেরেশতার চাইতে শ্রেষ্ঠ । আর নবী-রাসুলগণ হলেন মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতা তথা হজরত জিবরাইল (আ.), হজরত মিকাইল (আ.), হজরত ইসরাফিল (আ.) ও হজরত আযরাইল (আ.)-এর চাইতেও বেশি মর্যাদাবান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি মানবজাতিকে দুনিয়া দান করেছেন, তারা পানাহার করে, বস্ত্র পরিধান করে আর আমরা সদাসর্বদা আপনার প্রশংসা করি ও তাসবিহ পাঠ করি। আমরা পানাহার করি না কৌতুকও করি না। তাই মানবজাতিকে যেভাবে দুনিয়া দান করেছেন তেমনিভাবে আমাদেরকে আখিরাত দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাদের উত্তরে বলেন, যাদেরকে আমি কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছি তাদের সমতুল্য এমন কাউকে করবনা যাদেরকে আমি ‘কুন’ (হও) শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছি। (আল মুজামুল আউসাত : ৭/৯৯)

সম্মান ও সুখ্যাতি অর্জনের লোভ নিন্দনীয় : ইসলাম সম্মান ও খ্যাতি অর্জনের লোভ করাকে নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। খ্যাতি বা সম্মান অর্জনের প্রচেষ্টা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। অন্তরে নিফাক তৈরি করে। এক পর্যায়ে মানুষ শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। মুমিনের ইবাদত-বন্দেগি ধ্বংস করার জন্য এটি শয়তানের অন্যতম একটি ফাঁদ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুসারে কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে শহীদ, আলেম, দাতা বা দানশীল ব্যক্তিকে। যাদের সারা জীবনের ইবাদত রিয়া বা লোক দেখানো হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৫১৩, ১৯০৫) অপর হাদিসে রয়েছে, হজরত আবু সাঈদ (রা.) বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন দাজ্জালের চেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে আমি তোমাদের জন্য ভয় পায় সে বিষয়টি কি তোমাদের বলব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন, বিষয়টি হলো গোপন শিরক। তা হলো একজন ব্যক্তি সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে, মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে। (মুসনদে আহমদ, ৫/৪২৮, মাজমাউয যাওয়াইদ, ১/১০২)

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সবাই নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। তবে দীন প্রচারের জন্য, বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ অথবা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য কোনো কিছু প্রকাশ করেন তা দোষণীয় নয়। হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, শেষ জামানায় এমন মানুষ আসবে যারা কাজ প্রকাশ করাকে উত্তম এবং গোপন করাকে নিজের শত্রু মনে করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলো, এটি কীভাবে সম্ভব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এটা তারা করতে পারবে কারো প্রতি ভালোবাসার কারণে আর কারো প্রতি শত্রুতার কারণে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-২২৪০৫) আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি পার্থিবজীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দিব এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হলো সেসব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হয়েছে।’ (সুরা হুদ, আয়াত- ১৫ ও ১৬)

পদমর্যাদা ও পোশাক মুমিনের সম্মানের মাপকাঠি নয় : পৃথিবীতে মানুষ অনেক সময় বৈষয়িক পদ-পদবী, বেশভূষা দামি পোশাককে সম্মানের মাপকাঠি মনে করে। অথচ এরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত নাও হতে পারে। অন্যাদিকে জীর্ণ পোশাক ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেও আল্লাহর কাছে সম্মানিত হওয়া যায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিম্নমানের পোশাক পরিধান করেন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের অবস্থান হলো তারা যদি কোনো বিষয়ে কসম করেন, আল্লাহতায়ালা তার কসম পূরণ করার ব্যবস্থা করেন, অপর বর্ণনাতে রয়েছে তাদেরকে দেখলে মানুষ ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়, বিবাহের প্রস্তাব দিলে ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তারা মকবুল।’ ( মেশকাত শরিফ, হাদিস নং- ৫২৩১)

আরো পড়ুন :
গাইবান্ধায় সংখ্যালঘু পরিবারের বসত-বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর
লালপুরে লোকালয়ে দলছুট মুখপোড়া হনুমান
শিবগঞ্জে বেগুন ক্ষেত খাওয়ায় ছাগলকে জবাই

আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব রয়েছে মুমিনদের : মুমিনদের বন্ধুত্ব হলো আল্লাহর সাথে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য অনেক বড় সম্মানের বিষয়। আল্লাহই তাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহতায়ালা তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অনন্ধকার থেকে আলোর দিকে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৫৭) আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘মানুষদের মধ্যে যারা ইব্রাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা, আর এই নবী এবং যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠতম। আর আল্লাহতায়ালা হলেন মুমিদের বন্ধু।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৬৮) পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, জেনে রেখো আল্লাহতায়ালা রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত-১৯)।

জুলাই ০১.২০২১ at ১১:১২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর