রূপগঞ্জে সেদিন কী ঘটেছিল!

অন্যদিনের মতোই সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানায় কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত এই ভবনের নিচতলার ডান পাশের পুরোটাজুড়ে প্যাকেজিংয়ের কাজ চলছিল। বাম পাশে মজুদ ছিল প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ও বড় বড় কাগজের রোল।

সন্ধ্যার ঠিক একঘণ্টা আগে বিকাল ৬টার দিকে প্যাকেজিং মেশিনের স্পার্ক থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। আগুন লাগার পরে নিচতলার সবাই নিরাপদে বাইরে বের হয়ে আসেন। ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কেউ প্রাথমিকভাবে আগুন নিভানোর চেষ্টা করেননি। সঙ্গে সঙ্গে খবর দেয়া হয় ফায়ার সার্ভিসকে। ততক্ষণে নিচতলার সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে আগুন।

যেহেতু আগুন ঊর্ধ্বমুখী, ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় তলায়ও। আগুন লাগার খবরে ততক্ষণে দ্বিতীয় তলায় টোস্ট বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকা শ্রমিকরা উত্তরপাশের সিঁড়ি দিয়ে নিরাপদে নেমে পড়েন। এরই মধ্যে নির্বাপণ কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। দ্বিতীয় তলার জানালা দিয়ে আগুনের শিখা দেখে ভয়াবহতা বিবেচনায় একের পর এক বাড়ানো হয় ফায়ার ইউনিট।

আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে ধারণা করে, অন্য ফ্লোরগুলোর ফটকে তালা মেরে দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দ্বিতীয় তলায় প্লাস্টিকের কাঁচামাল ও টোস্টের প্যাকেট থাকায় আগুনের লাগাম টেনে রাখা যায়নি। তৃতীয় তলায় আগুন প্রবেশ করা শুরু করে। ফলে তৃতীয় তলায় আটকা পড়া শ্রমিকরা কারখানার একটি ল্যাডারে করে নিচে নামতে শুরু করে।

লিচু ড্রিংসসহ বিভিন্ন ড্রিংস তৈরি হওয়া এ ফ্লোরে অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ ও প্লাস্টিকের বোতল থাকায় বাতাসের বেগে আগুন ছড়াতে থাকে। এতে শিশু শ্রমিক ও বয়স্ক নারীরা সেখানে অবস্থান করতে পারছিলেন না। কয়েকজনকে নামানো হলেও বাকিরা মৃত্যুভয়ে লাফ দিতে থাকেন। এতে ঘটনাস্থলে দুই নারীসহ মোট ৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন শিশুসহ বেশ কয়েকজন। রাত ৮টার দিকে আগুন চতুর্থ তলায় প্রবেশ করে।

কিন্তু চতুর্থ তলার কাউকেই ওই ফ্লোর থেকে কোথাও যেতে দেননি ফ্লোর ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান। আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে- তার এমন আশ্বাস সবাই মেনে নেন। ওই ফ্লোরে থাকা সবাই উত্তরপূর্ব পাশের মাহবুবুর রহমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রুমে আশ্রয় নেয়। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মোবাইল ফোনে আগুন লাগার খোঁজখবর নেন মাহবুবুর রহমান। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা চতুর্থ তলায় প্রবেশ করলে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন সবাই।

ধোঁয়ায় দম আটকে আসছে বলে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে চিৎকার করে জানাতে থাকেন তারা। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ও ফায়ার কর্মীরা তাদের যে কোনোভাবে ছাদে উঠে অবস্থান নিতে বলেন। কিন্তু মূল ফটকের পাশের সিঁড়িতে (দক্ষিণ পশ্চিম পাশের) তখন আগুন পৌঁছে গেছে। ছাদে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল উত্তর পাশের সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়িটি লোহার নেট দিয়ে আটকানো ছিল। সেখানকার দরজাতেও ছিল তালা লাগানো। বেশ কয়েক মিনিট নেটের ওই দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন সবাই।

কিন্তু নসিলা, ঘি, ললিপপ ও লজেন্স বানানো এই ফ্লোরে প্লাস্টিক দানা ও বোতলের কারণে আগুন ছড়াতে সময় লাগেনি। উপায় না দেখে ওই ফ্লোরে থাকা সবাই আবারো জানালা দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। অক্সিজেন সাপোর্ট চেয়ে আর্তনাদ করতে থাকেন। কিন্তু নিরুপায় ছিল সবাই। রাত পৌনে ৯টার পর আর কারো আর্তনাদ বা চিৎকার শোনা যায়নি সেখানে। এরই মধ্যে ৫ম তলায় থাকা শ্রমিকরা ভবনের ছাদে অবস্থান নেন।

আগুন ৪র্থ তলায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে ৫ম তলার দিকে ধাবিত হয়। এরই মধ্যে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় উত্তরপূর্ব পাশের ওই এসি রুমে থাকা ৪৯টি তাজা প্রাণ। সহকর্মীদের বাঁচানোর জন্য যে ফ্লোর ইনচার্জ নিজ রুমে সবাইকে ঠাঁই দিয়েছিলেন, সবার সঙ্গে তিনিও পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের নির্বাপণকারী দল বুঝতে পারে ভেতরে অনেকে নিহত হয়েছে।

ইতোমধ্যে কেউ কেউ আহত অবস্থায় বের হয়ে ভেতরে অনেকে আটকা আছে বলে জানায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কারখানার বাইরের বাউন্ডারির পূর্ব পাশের গেট তালাবদ্ধ করে দেয়। এসময় ভেতরে আটকা পড়াদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পুরো কারখানা এলাকার আকাশ বাতাস। স্বজনদের রক্ষায় ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের কথায় কোনো কর্ণপাত করেনি। এসময় ৪টি ফ্লোরে একযোগে আগুন জ্বলতে থাকায়, নির্বাপণের জন্য পূর্ব পাশের বাউন্ডারি ফটক খুলে দেয়ার দাবি জানায় স্থানীয়রা।

তখনো কারো কথায় কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সারারাত ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আপ্রাণ চেষ্টা করে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় আটকে পড়াদের। ৫ম তলায় লাচ্ছা সেমাই প্যাকেট করার প্লাস্টিকের প্যাকেট ও অন্যপাশে প্লাস্টিকের দানার স্টোর থাকায় আবারো নতুন বাক নেয় আগুন। ৫ম তলায় ফায়ার সার্ভিস পানি দিতে থাকলেও আগুনের তেজ বাড়তে থাকে।

এরই মধ্যে সকাল হয়ে যায়। এত দীর্ঘ সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয় নিহতদের স্বজন, কারখানার শ্রমিক ও স্থানীয়দের মধ্যে। আগুন ৫ম তলা পেরিয়ে ৬ষ্ঠ তলায় পৌঁছালে আরো বেড়ে যায়। কারণ ৬ষ্ঠ তলাটি ছিল কার্টনের স্টোর। এতে আরো বেকায়দায় পড়ে ফায়ারম্যানরা।

তবে, ৪র্থ তলা পর্যন্ত ভবনটি ধ্বংসস্তূপে রূপান্তরিত হলেও আগুনের ধ্বংসলীলা থেমে যায়। মাহবুবুর রহমানের সেই রুমটি থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় ৪৯টি মরদেহ। যেগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে বিকৃত হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্সে করে সেগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায় পুলিশ।

কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতার অভিযোগ এনে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও রাস্তা অবরোধ করে কারখানা শ্রমিক ও স্থানীয়রা। অপরদিকে প্রশাসনের কাছে দীর্ঘ হতে থাকে নিখোঁজ শ্রমিকদের নামের তালিকা। ২১ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও গতকাল শনিবার দুপুরেও ভবনের নিচতলা, চতর্থ তলা ও ৬ষ্ঠ তলায় আগুনের ধোঁয়া দেখা গেছে। তবে ভবনটিতে আর কোনো মৃতদেহ নেই বলে নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের মূল ফটকের ডান পাশে কমপক্ষে ১৫টি প্যাকেজিং মেশিন রয়েছে। বাম পাশ ফুয়েল পেপার ও কাগজের রোলে ঠাঁসা। মেশিনগুলো পুড়ে অঙ্গার। কাগজের রোল থেকে ধোঁয়া উড়ায় পানি দিয়ে নির্বাপণের কাজ করছিলেন বেশ কয়েকজন ফায়ারকর্মী। মূল ফটকের সঙ্গে থাকা ভবনের সিঁড়ি ও গ্রিল আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জানালার গ্রিল ও সিঁড়ির গ্রিলের প্রতিটি শিক বেঁকে গেছে। ছাদ থেকে খুলে পড়ছে পলেস্তার। সব কয়টি তলার একই অবস্থা। প্লাস্টিক গলে জমাট বেঁধে আছে বিভিন্ন জায়গায়। পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের কণা। ৪র্থ তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ললিপপ, লজেন্সের প্যাকেট, ঘিয়ের প্লাস্টিকের বোতল। উত্তরপূর্ব পাশের রুমের দিকে তাকালে বোঝা যায় কি নির্মম মৃত্যু হয়েছে সেই ৪৯ জনের।

রুমটিতে দুটি এসির ধ্বংসাবশেষ ঝুলছে, একটি স্ট্যান্ড ফ্যান পুড়ে কয়েক খণ্ড হয়ে পড়ে আছে, ফ্লোরে প্লাস্টিকের স্তর পড়ে আছে, মেশিনগুলোতে সংযোগ হওয়া হাই ভোল্টেজ তারও ধসে পড়েছে। রুমটির মধ্যে এখনো লাশের গন্ধ। যা ক্ষণিকের জন্য মনে করিয়ে দেয় নিহতদের আর্তচিৎকার ও অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার দৃশ্য। পূর্ব পাশের সিঁড়িটি এখনো তালাবদ্ধ থাকলেও সেটি যে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়। ৫ম তলার ফ্লোর ও ৬ষ্ঠ তলার ছাদ ধসে পড়লেও সেখানে আগুনের ধোঁয়া রয়েছে। পাশাপাশি পুরো ভবনের বাতাসে পোড়া গন্ধ ভয়াবহতা সম্পর্কে মনে করিয়ে যে কারো মনে ভয় ধরিয়ে দেবে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার নিচতলায় থাকা প্যাকেজিং মেশিনের স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আগেও এই প্যাকেজিং মেশিনে স্পার্কের ঘটনা ঘটেছিল। যদিও কারখানাটির ইলেক্ট্রিক বিভাগের উপসহকারী ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এ বিষয়ে তার জানা নেই। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিন এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও মেনটেইন্যান্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিল্লুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, উদ্ধার অভিযান শেষ করে তদন্ত কাজ শুরু করা হবে।

তবে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি ভবনের মূল ফটকের বাম পাশ থেকে (যেখানে প্যাকেজিং মেসিং) আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। আমরা তদন্ত করলে বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিল্ডিং কোডের কিছুই ভবনটিতে মানা হয়নি। ছিল না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। বহির্গমনের জন্যও জরুরি সিঁড়ি রাখা হয়নি। উল্টো দাহ্য পদার্থে ঠাসা ছিল পুরো ভবন। এজন্য ভয়াবহতা বেড়েছে।

এদিকে গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

আরো পড়ুন:
যশোরে এমপি নাবিলের পক্ষে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ
পশুরহাট ও কোরবানির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২৩ নির্দেশনা

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বিকালে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৫২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক শ্রমিক।

জুলাই,১১.২০২১ at ১১:৩৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এমটি/এসআর