অবাধে বসছে পশুর হাট, স্বাস্থ্যবিধি নেই

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের দৌরাত্ম্যের মধ্যে সারাদেশে আগের মতো করেই চলছে পশুর হাট। এর মধ্যে নিয়মিত হাটগুলোতে পশু বিকিকিনি বেড়েছে। সারা বছর ধরে বা সপ্তাহে নিয়মিত যেসব পশুর হাট ইজারা রয়েছে সেসব হাট চলছে স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই।

বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার দেশের প্রায় সব উপজেলাতেই একাধিক পশুর হাট বসে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়ায় নেয়াখালীর হাতিয়া ও সুনামগঞ্জে দুটি হাট বন্ধ করে দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে আসন্ন ঈদুল আজহায় কুরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্ধারিত স্থানে কুরবানির পশুর হাট বসবে।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাস্ক নিশ্চিতের পাশাপাশি হাটে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে চলবে অভিযান। রাজধানীতে বসবে ২৩টি হাট। ঈদের এক সপ্তাহ আগে বসবে কুরবানির পশুর হাট। এর আগে হাট শুরু করলে অভিযান চালাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি)মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গতকাল শনিবার ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা মহামারিতে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে মানতে হবে। সারা বছর বা সপ্তাহে যেসব পশুর হাট বসে তাতেও স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর।

কুরবানির পশুর হাটে কী হবে- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ নিয়ে তারা বৈঠক করেছেন। আরো বৈঠক হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করা হবে। এখন পর্যন্ত সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা রয়েছে তা সবার জন্য প্রযোজ্য।

জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে শুক্রবার বৃহৎ পশুর হাটে হাজারো মানুষ উপস্থিত ছিল। এ সময় হাটে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই ছিল না। অধিকাংশ মানুষের মুখে ছিল না মাস্ক। বিধি ভঙ্গ করেই অবাধ বিচরণ ছিল মানুষের।

সরকার নির্দেশিত কঠোর বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে হয়েছে পশুর হাট। শুক্রবার দুপুরে উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের ভুটিয়াকোনা বাজারে কুরবানি পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে আসেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। এ সময় অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক ছিল না। কারো কারো মাস্ক থাকলেও হয় পকেটে, না হয় থুতনিতে ঝুলানো ছিল। সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা না নেমে ঝুঁকি নিয়ে চলে পশু কেনাবেচা।

বগুড়ায় মহাস্থান পশুর হাট জমে উঠেছে। বিক্রির জন্য দূর-দূরান্ত থেকে পশু নিয়ে আসছেন বিক্রেতারা। প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে ক্রেতাদের। চলছে জমজমাট বেচাকেনা। তবে হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে করোনা নিয়ে ছিল না সচেতনতা। তোয়াক্কা করেনি স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই। এতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। শুক্রবার শরীয়তপুর গোসাইরহাট সদরের দাসেরজঙ্গলে বসে গরুর হাট।

হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে মাস্ক থাকলেও অধিকাংশের মুখে ছিল না মাস্ক। তাদের মাস্ক ছিল থুতনির নিচে। কেরানীগঞ্জের হযরতপুর পাড়াগাঁও হাট বসে প্রতি শনিবার। পাশে সিংগাইর সিরাজনগর হাট বসে প্রতি বুধবার। আশুলিয়া বাজারের সাপ্তাহিক পশুর হাট বসে বুধবার। শিমুলিয়ার গোহাইবাড়ীতে প্রতি শুক্রবার বসে এই হাট। এসব হাট চলছে আগের মতোই বড় পরিসরে। হাটের ইজারাদাররা যেমন স্বাস্থ্যবিধির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেননি তেমনিভাবে ক্রেতা-বিক্রেতারাও উদাসীন। দেশের সব জেলা-উপজেলার পশুর হাটের চিত্র যেন একই।

এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার উপজেলা সদরের ওচখালী বাজারে সরকারি আদেশ অমান্য করে লোক সমাগম করে পশুর হাটের আয়োজন করায় তা ভেঙে দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন। আইন অমান্য করায় পশুর হাটের ইজারাদারকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন লকডাউনে দায়িত্ব পালন করা নৌবাহিনীর সদস্যরা। একই দিনে সুুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পাটলি ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজারে পশুর হাট বন্ধ করে দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ১২ জুন রবিবার অনলাইনে ঈদুল আজহা-২০২১ উপলক্ষে কুরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনা, নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাই এবং বর্জ্য অপসারণের প্রস্তুতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি)মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশর্^বর্তী দেশ হওয়ায় আমাদের দেশেও কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় এ ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে।

তাই এ বছর সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেই পশুর হাট বসানো হবে। তিনি আরো বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ পশুর হাট বসানোর জন্য এবং পশু জবাইয়ের যে স্থান নির্ধারণ করবে শুধু সেখানেই হাট বসবে। এর বাইরে কুরবানির পশুর হাট বসতে ও পশু জবাই করতে দেয়া হবে না। শহর-নগর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ এলাকায় সবার জন্য সুবিধামতো জায়গায় গরুর হাট বসানোর ব্যবস্থা করবে।

মো. তাজুল ইসলাম বলেন, অনেক জায়গায় সড়ক-মহাসড়ক এবং রেললাইনের ওপর কুরবানির পশুর হাট বসানো হয়। কর্তৃপক্ষ এসব জায়গায় হাট বসানোর ইজারা দেয় না। কিন্তু অবৈধভাবে এসব জায়গায় পশুর হাট বসানো হয়। রাস্তার ওপর পশুর হাট বসানো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রোডস এন্ড হাইওয়েজ কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগে এটি বন্ধ করতে হবে। যেখানে সেখানে হাট বসতে দেয়া যাবে না।

তিনি আরো বলেন, কুরবানি দেয়ার পর পরই দ্রুত বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌর মেয়রসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সব জনপ্রতিনিধি স্ব-স্ব উদ্যোগে দ্রুত বর্জ্য অপসারণ করবেন।

মন্ত্রী আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পশুর হাট বসানোর জন্য গত বছর গণমাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ বছরও এটি করা হবে। সিটি করপোরেশন ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাবে বলেও জানান তিনি।

এ সময় সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনদুর্ভোগ কমাতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী।

এ সভায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সব সিটি করপোরেশনের মেয়র, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য, তথ্য ও সম্প্রচারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং বিভিন্ন অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

নোয়াখালীতে পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত : চলমান লকডাউনের মধ্যে নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে বসছে পশুর হাট। এসব পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলেও একশ্রেণির মুনাফাভোগী ইজারাদার মানছেন না সরকারি বিধিনিষেধ।

হাটে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কেউ দাম করছেন, কেউ পশু কিনে পিকআপে তুলছেন। উপস্থিত ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশের মুখে নেই কোনো মাস্ক। সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে বাজার পরিচালনা করছেন ইজারাদাররা। শুক্রবার সদর উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নের বাংলাবাজার ও এওজবালিয়া ইউনিয়নের করমূল্যা বাজারে পশুর হাটে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এতে প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সদর উপজেলার সর্ববৃহৎ পশুর হাট দত্তেরহাট বাজারের ইজারাদার আবদুল মমিন বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনে গত ১১ জুন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দত্তেরহাটে পশু বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়া হলেও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় পশুর হাট বসিয়ে গরু-ছাগল বেচাকেনা চলছে। আসন্ন কুরবানি ঈদ উপলক্ষে পশু কুরবানি, খামারি ও ইজারাদারদের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব পশুর হাটই খুলে দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই ইজারাদার।

বাংলাবাজারে গরু কিনতে আসা গিয়াস উদ্দিন মঞ্জু বলেন, সব কিছু স্বাভাবিক সময়ের মতোই চলছে। কেউ-ই সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। এমনকি মুখে মাস্কও ব্যবহার করছেন না। ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের কিছুু বলছেন না।

গরু বিক্রেতা মাইজচরা গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে জাহের উদ্দিন বলেন, কুরবানির হাটকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলার সীমান্তবর্তী গরুর হাট বাংলাবাজারে প্রচুর গরু বেচাকেনা হয়। করোনার কারণে ঈদের আগ মুহূর্তে বাজার মিলবে কিনা এমন শঙ্কায় এখন বাজারে মানুষের ভিড় একটু বেড়েছে। হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবার জন্যই মঙ্গল।

বাজারের (সাপ্তাহিক, নিয়মিত পশুর হাটসহ বাজার) ইজারাদার ফারুক মাঝি বলেন, এ হাটে নিয়মিত ব্যবসায়ীসহ ক্রেতা-বিক্রেতাদের আগেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, মুখে মাস্ক পরতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারপরও করোনা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা বললেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে বাজার বন্ধ করে দেয়া হলে ইজারাদারদের পথে বসতে হবে।

আরো পড়ুন:
দিনাজপুর থেকে পায়ে হেঁটেই উল্লাপাড়ায় যাচ্ছেন আলম ও মনির
চৌগাছায় কঠোর লকডাউনের তৃতীয় দিনে ৩ জনকে অর্থদন্ড

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা বলেন, গত বছর কুরবানির সময় সদর উপজেলায় ২৭টি অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দেয়া হয়েছে। এ বছর এখনো পশুর হাট বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় ওই বাজারগুলো ইজারা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, লকডাউনের মধ্যে পশুর হাট বসানোর সংবাদ পেয়ে বাংলাবাজারে পশু বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়া হয়।