এই আধো আধো ভাষার প্রয়োগে না শান্তি খুজে পাই না পাই আধুনিকতা

লেখক: আহমেদ সাব্বির, চলচ্চিত্র নির্মাতা।

সে বেশ আগের কথা ; তখন আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র । আমাদের গ্রামের এক ভদ্রলোক শশুরবাড়ির সহায়তায় সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সহ আমেরিকা চলে গেলেন। তিনি যখন দেশে ফিরলেন তখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি । তার আশার খবরটা পেয়েছিলাম তার এক নিকট আত্নীয়র কাছে । তিনি বলছিলেন বিদেশ ফেরত ভদ্রলোকের নাকি একটা ছেলে আছে । তার জন্ম যেহেতু আমেরিকায় সুতরাং সে আমেরিকার নাগরিক । আর তাকে নিয়ে তিনি সব থেকে গর্ব করে যে কথাটি বললেন সেটা হল, ছেলেটা নাকি একদম বাংলা বলতে পারেনা। আমি সেদিন বুঝি নাই বাংলা বলতে না পারা কেন গর্বের বিষয়! এরপর আমি মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হলাম ঢাকার খুব নামকরা একটা কলেজে। এ কলেজে বাংলা এবং ইংরেজী উভয় মাধ্যমেই পড়াশোনা করার ব্যবস্থা আছে। এখানে পড়তে এসে দেখলাম এখানে যারা পড়ে তারা হরহামেশাই ইংরেজী ব্যাবহার করে। আমি যেহেতু তাদেরই সহপাঠী এবং ছাত্র হিসেবে খারাপও না সেহেতু আমার তাদের কথা বুঝতে অসুবিধা হত না । তবে দেশের মাটিতে বিদেশী ভাষার এমন ব্যবহার আমার কাছে একটু অপ্রয়োজনীয় মনে হত ।

যাই হোক ,ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক আমার এই ভাষার মাহাত্ম্য তখনো আবিষ্কার করতে পারে নাই । প্রথমবার এই ভাষার গুরুত্ব আবিষ্কার করেছিলাম একটা দামী রেস্তোরায় খেতে গিয়ে । সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম সেখানে । এই দুই ঘন্টায় যেটা দেখলাম আর উপলব্ধি করলাম তার সারমর্ম হলো , যারা ইংরেজিতে কথা বলে তাদের অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এর পর আসি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রসঙ্গে । বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ার একদম শুরুর সময় থেকেই আমি একটি প্রথম শ্রেনীর বিজ্ঞাপন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম । তো কাজের সুবাদে আমাকে দেশী বিদেশী নানা ধরণের মানুষের সাথে কথা বলতে হত আর সেজন্য আমাকে ইংরেজী ভাষাটাও ব্যবহার করতেই হত এবং আমি আনন্দের সাথেই সেটা করতাম ।

এরই মধ্যে আমার অনেক বন্ধু বান্ধব হলো । অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠতা হলো। আমার চায়ের দোকানে , পার্কে, রেস্তোরাঁয় কিংবা আমাদের বাসায় বিভিন্ন সময়, কারণে অকারণে আড্ডা দেয়া শুরু করলাম এবং এখানেও ইংরেজীর বিশেষ কদর এবং বাংলার প্রতি অনীহা আবিষ্কার করলাম আরেকবার । অনেক সময় আড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে উঠত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আমাদের প্রিয় এবং অপ্রিয় পাঠ্য বিষয় , অথবা সহজ বা কঠিন পাঠ্য বিষয় । বাংলাকে কখনো কারো প্রিয় পাঠ্য বিষয়ের তালিকায় পাইনি , বিশেষ করে বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে অনেককেই যাতা রকমের বিরক্ত হতে দেখেছি ।

এই মহলে আরেকটা বিষয় আমার বিশেষ চিন্তার কারণ ছিলো তা হলো, আমাদের ভেতর যারা কথা বার্তায় ইংরেজী শব্দ বেশী ব্যাবহার করে তাদের ভালো এবং উচ্চ বংশীয় মনে করার একটা প্রবণতা ছিলো প্রকটভাবে । তো এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এখন রোজই যাই যেখানে বাংলার প্রতি তাচ্ছিল্য বেশ ভালো ভাবেই পরিলক্ষিত । তবে আমি আমার আশেপাশে এখন পর্যন্ত খুব কম বাঙ্গালীকে দেখছি যারা বাংলা পারেনা অথচ ইংরেজী ভাষাটা ঠিক ঠাক বলতে পারে । মানে এই যে সব ইংরেজী বলনেওয়ালাদের কথা বললাম সত্যি বলতে এরা পরিস্কার ইংরেজীও বলতে পারেনা। তবে এমন কিছু মানুষ আমি দেখেছি যারা বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারেন এবং তাদের আমি কখনো ভাষার মধ্যে বৈষম্য করতে দেখিনি।

আসলে যারা নিজের ভাষা ঠিক মত আয়ত্ব করতে পারে তারা যেকোন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে বলে আমার ধারণা ।এই আধো আধো বাংলা আর আধো আধো ইংরেজীটা ব্যাক্তিগতভাবে আমি ঠিক গ্রহণ করতে পারিনা। আমি বলবো না আমার মধ্যে প্রচন্ড দেশপ্রেম তবে ভাষার শুদ্ধতা আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন । এই আধো আধো ভাষার প্রয়োগে না শান্তি খুজে পাই না পাই আধুনিকতা । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমার প্রতিজ্ঞা , বাংলা ভাষা নিয়ে ঘুরে বেড়াবো বিশ্ব চরাচর । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সফল হোক । সবাই খুব সহজে বুঝুক, বাংলা কঠিন ভাষা নয় কঠিন সেই সব মানুষের মন যারা ভালবেসে বাংলা পড়েনা, শোনেনা এবং বাংলার রস আস্বাদন করেনা ।

লেখক: আহমেদ সাব্বির, চলচ্চিত্র নির্মাতা