দৌলতপুর থেকে বিদায় নিলেন জনবান্ধব এসিল্যান্ড আজগর আলী

বিদায় শব্দটা কেমন যেন মন খারাপের মনে হয়। তবে সব বিদায় আবার মন খারাপেরও নয়। চাকরি জীবনের ক্ষেত্রে এই বিদায় শব্দ কমন একটা বিষয়। সেই কমন বিদায়েরই আওতায় পড়েছেন কর্মগুণে সবার প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে ওঠা আজগর আলী। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা প্রশাসনে সত্যিকার অর্থেই একজন ন্যায় নিষ্ঠাবান ও জনবান্ধব কর্মকর্তা ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি), নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আজগর আলী। প্রায় দুই বছর ধরে সততাকে সঙ্গে করে অত্যন্ত সুনামের সাথে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এসেছেন তিনি। এ উপজেলায় বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তার মতো ভালো মনের এবং ভালো মানের এসিল্যান্ড পাওয়া যায়নি।

বছর দশেক আগে এসিল্যান্ড সিদ্ধার্থ শঙ্কর কুণ্ডু প্রায় একইভাবে সুনামের সাথে এখানে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মাঝখানে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে নাহিদা আক্তার ছাড়া অন্যদের কর্মকাণ্ড এখানকার মানুষের কাছে মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। তারা প্রত্যেকেই কমবেশি জড়িয়েছেন অনিয়ম দুর্নীতিতে। হয়েছেন সমালোচিত। আর আজগর আলীর ক্ষেত্রে ছিল পুরো উল্টো চিত্র। তিনি দায়িত্বে, কর্তব্যের পরতে পরতে নিষ্ঠা ও সততার ছাপ রেখেছেন। নিজের কর্মগুণেই এখানকার সব মহলের মানুষের কাছে হয়েছেন ব্যাপক প্রশংসিত।

বেশ দীর্ঘ একটা সময় পরে দৌলতপুর উপজেলাবাসী পেয়েছেন অত্যন্ত বিনয়ী, কর্মপরায়ণ ও মেধাবী এসিল্যান্ড আজগর আলীকে। তার কর্মদক্ষতা আর জনবান্ধব আচরণ এখানকার মানুষ দীর্ঘকাল মনে রাখবে বলে অনেকে জানাচ্ছেন। সরকারের মাঠ প্রশাসনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের মাঝে যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন সবগুলোই আজগর আলীর মাঝে লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত দপ্তরগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ভূমি দপ্তরের দায়িত্বে থেকে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি নিজের সেরাটাই বিলিয়ে দিয়েছেন এখানকার মানুষকে। কারো বাহবা পেতে অথবা লোক দেখানোর মতো ভাঁড়ামিমার্কা কাজকাম তাকে স্পর্শ করতে পারেনি একটুও।

দায়িত্বের বাইরেও বেশ কিছু মানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। বিশেষ করে করোনাকালে তার ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। দিন-রাত সমানে চষে বেড়িয়েছেন উপজেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের স্বজনরাও যখন আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মরদেহের কাছে ভেড়েননি, তখন এসিল্যান্ড আজগর আলী এবং ওসি আরিফুর রহমান নিজ হাতে তাদের লাশ দাফন করেছেন। পরবর্তীতে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ওসি আরিফ মৃত্যুবরণ করেন। এসিল্যান্ড আজগর আলীর শরীরে দুইবার করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও সৌভাগ্যক্রমে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তারপরেও থেমে থাকেননি, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি করোনা পরিস্থিতিতে পুরো উপজেলা দাবড়ে বেড়িয়েছেন।

আরও পড়ুন:
৩ কোটি রুপিতে কলকাতায় সাকিব, এক কোটিতে রাজস্থানে মোস্তাফিজ
বিবাহিত পুরুষ টার্গেট জাহ্নবীর
৫৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি আসছে

তার মানসিকতা কেমন দুয়েকটি উদাহরণ দিলেই সবার সামনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আগের বছরে পদ্মায় মা ইলিশ সংরক্ষণে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতেের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এসিল্যান্ড আজগর আলী। মা ইলিশ ধরার কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এক জেলেকে জালসহ আটক করা হয়েছিল। গরিব জেলের পরিবারের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় এনে পাশাপাশি আইনেরও বিধান মেনে ওই জেলেকে তিনদিনের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। অথচ প্রায় একই অপরাধের দায়ে জেলার অন্য একটি উপজেলায় তিন জেলেকে ১ মাস করে কারাদণ্ড দেয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দৌলতপুরের এসিল্যান্ড আজগর আলী ইচ্ছা করলে এখানকার ওই জেলেকেও ১ মাস কারাদণ্ড দিতে পারতেন। পুরো মাস তাকে কারাদণ্ড দেয়া হলে তার পরিবারে অাহার জুটবে না, বাইরে থাকলে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা হবে- এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একই সঙ্গে আইনেরও বিধান মেনে তাকে তিনদিনের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। মাঠ প্রশাসনের এই কর্মকর্তার এ রকম মানবতাবোধ বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সে সময় মৎস্য দপ্তর থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছিল।

দৌলতপুর উপজেলার বেগুনবাড়ি গ্রামে স্বামী নিগৃহীত এক কিশোরী বধূ ও তার পরিবার সুবিচানের জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে বারবার নাজেহাল হচ্ছিল। মাস চারেক আগে অসহায় পরিবারটি এসিল্যান্ড আজগর আলীর দপ্তরে গেলে তিনি ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে শোনেন। তাদের নিজ দপ্তরে বসিয়ে রেখে অভিযুক্ত মাসুমের বক্তব্য শোনার জন্য এক ঘণ্টার ভেতরে তাকে হাজির করতে দপ্তর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এসিল্যান্ড দুপুরে খাবার খেতে না গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু সেখানে হাজির হয়নি ওই কিশোরীকে স্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতকারী প্রতারক মাসুম। পরে এসিল্যান্ড আজগর আলী ভিকটিম ও তার পরিবারকে জানিয়ে দেন, ঘটনাটি অবশ্যই ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এই অপরাধ মোবাইল কোর্টে বিচার্য নয়। ভুক্তভোগী পরিবারটির ন্যায্য বিচারের স্বার্থে তিনি তাদের থানা কিংবা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার মাধ্যমে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে মামলা পরিচালনার জন্য অসহায় পরিবারটিকে ব্যক্তিগতভাবে অার্থিক সহযোগিতার কথাও জানান তিনি।

এসিল্যান্ড আজগর আলীর মতো সৎ, বিচক্ষণ ও মানবিক কর্মকর্তাদের এ দেশের প্রশাসনে খুব জরুরি। কোনো মানুষই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, তিনিও এর বাইরে নন। তারপরেও তার আন্তরিক চেষ্টা ছিল নিজের দপ্তরকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে মানুষের কাঙ্ক্ষিত সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা। যদিও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরনো প্রথা ভাঙা খুব সহজ কাজ নয়, তবে নানামুখী সীমাবদ্ধতার মাঝেও তিনি পুরোপুরি না হলেও সফল হয়েছেন অনেকটাই। সেবাপ্রার্থীরা এই জনবান্ধব কর্মকর্তার আইনগত ও যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়েই বাড়ি ফিরেছেন। একজন মানুষের পক্ষে সবার মন রক্ষা করে চলা কোনোভাবেই সম্ভব না, কিন্তু তার প্রতি কাউকে কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এটিও ছিল তার অন্যতম একটা অর্জন।

বদলিজনিত কারণে উপজেলা প্রশাসনের এই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তাকে বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিদায় জানালো দৌলতপুরবাসী। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলা অফিসার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলে বদলি করা হয়েছে তাকে। আগামী রোববার সেখানে যোগ দেয়ার পর তার পরবর্তী দায়িত্ব নির্ধারিত হবে। তবে সেখানকার চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে তাকে নিযুক্ত করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশে দৌলতপুর ত্যাগ করেছেন। দৌলতপুর থেকে বিদায় নেয়া এখানকার সদ্যসাবেক এসিল্যান্ড আজগর আলী তার নতুন কর্মস্থলেও একইভাবে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা দৌলতপুরবাসীর।

আরও পড়ুন:
‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ প্রতিবেদনটি সরাতে সোস্যাল মিডিয়াকে বিটিআরসি‘র চিঠি
৩ কোটি রুপিতে কলকাতায় সাকিব, এক কোটিতে রাজস্থানে মোস্তাফিজ
কেশবপুরে পৌরসভা নির্বাচন : ধানের শীষের কর্মীকে অপহরণ অভিযোগে নৌকার ২ কর্মী আটক