যশোরের উন্নয়ন ও কিছু কথা

যশোর অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাটির সৃষ্টি হয় আজ থেকে প্রায় দুইশত চৌত্রিশ বৎসর পূর্বে ১৭৮৬ সালে। প্রথম প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন যশোর জেলার সীমানা-খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং আজকের চুরাশিপূর্ব অবিভক্ত যশোরসহ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

১৮৭৬ থেকে ১৯৮৪ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যশোরের গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন যশোর জেলা আজ শুধুমাত্র তার একটি খণ্ডিত অংশ নিয়ে টিকে আছে।

গৌড়ের পতনের পর সেখানকার হৃত ধন-সম্পদ,স্থাপত্য তথা সামগ্রিক রাজযশ যশোরে এনে জড়ো করার ফলে যশোরের শ্রীবৃদ্ধি আর সমৃদ্ধি ঘটে বলেই অনেকেই মনে করেন। সেজন্য এর নাম যশোর। যদিও এনিয়ে মতদ্বৈততা আছে। তবে যশোরের যশ না থাকলে সুচতুর ব্রিটিশ সরকার কেনইবা যশোরে জেলা স্থাপন করবেন। অর্থাৎ অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে যশোর একটি ঐতিহ্যেবাহী জেলা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় ৫০ বছরে সেই যশ নেই। মনে হয় যশোরের যশ যেন সত্যিই কেউ হরণ করেছে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন , নীল বিদ্রোহ, তে-ভাগা আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে যশোরবাসী। কষ্ট হয়, দুঃখও লাগে। আমরা কেন পিছিয়ে গেলাম এই চিন্তা করে।

অথচ এই যশোর রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোর, ইলামিত্রের যশোর। এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন বাঘা যতীন। প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন মোঘল মানসিংহের কাছে। আর ইলামিত্র এবং বাঘা যতীন রুখে দাঁড়িয়েছিল শক্তিশালী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা। তিনি নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবে গণ্য হন। তিনিও যশোরের সন্তান। মোহাম্মদ কাজেম ফরায়েজি বা কাজী মফিজুল আসলাম চিশতি জন্মেছিলেন এই যশোরেই। তারা ফরায়েজি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রচার করেছেন সাম্যের বাণী।

পারস্যের শিরাজ নগরীতে অসংখ্য কবি প্রতিভার জন্ম হয়েছিল। আর বহু কবি-সাহিত্যিকের জন্মভূমি যশোর। তাই যশোরকে বাংলাদেশের শিরাজ বলা হয়। পাগলা কানাই, লালন শাহ,মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গোলাম মোস্তফা, দীনবন্ধু মিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ নওশের আলী, মনোজ বসু,ডা. লুৎফর রহমান, উদয় শঙ্কর, রবি শঙ্কর,কেপি বোস, কবি ফররুখ আহমদ, এসএম সুলতান, প্রফেসর নুর মোহাম্মদ মিয়া, সৈয়দ আলী আহসান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আকরম হোসেন,ড শমসের আলী , সুচন্দা,ববিতা প্রমুখ কীর্তিমান এ যশোরেরই সন্তান।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোরবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয় যশোর থেকেই। চার খলিফার একজন স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহায়ক নূরে আলম সিদ্দিকীও এই যশোরের।

তাহলে আজ আমাদের কেন এই অবস্থা। আমরা কী শুধু খেজুরের গুড় বা পাটালিতে বলে বিখ্যাত এই পরিচয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবো?

যশোরের জনগণ সরকারের কাছে কিছু দাবি বিভিন্ন সময়ে করে আসছে। তাদের সেই দাবিগুলো হলো

১. যশোরকে পৃথক বিভাগ ও সিটি করপোরেশন ঘোষণা ও বাস্তবায়ন
২. নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও যশোরে চারটি অর্থনৈতিক জোন এবং যশোরে দেশের তৃতীয় অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা দেয়া
৩. যশোর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ
৪. পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, লালন ও মধুসূদনের নামে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়, মহিলা ক্যাডেট কলেজ, নড়াইল ও ঝিনাইদহে মেডিকেল কলেজ স্থাপন
৫. বেনাপোল স্থলবন্দর আধুনিকায়ন
৬. দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পদ্মা টানেল অথবা পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং দৌলতদিয়া-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ
৭. চার জেলায় আন্তঃজেলা রেল যোগাযোগ, ঢাকা-খুলনা চলমান রুটে নতুন একটি রেল চালু এবং খুলনা-কলকাতা ট্রেন যশোরে যাত্রাবিরতি
৮. যশোরের চারটি জেলায় গ্যাস সরবরাহ
৯. যশোরে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ
১০. বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা স্থাপন
১১. পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ
১২. ফুলের গবেষণার জন্য একটি গবেষণা কেন্দ্র যশোরে স্থাপন
১৩. যশোরে একটি কন্টেইনার ডিপো স্থাপন করা
১৪. হ্যাচারি শিল্পে প্রণোদনা
১৬. নকশিকাঁথা তৈরিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা
১৭. সবজিভিত্তিক কোল্ড স্টোরেজ প্রতিষ্ঠা
১৮. শিল্প ও নদীবন্দর নওয়াপাড়ার ভৈরব নদীর ড্রেজিং ও অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ, ১৯. ভবদহ সমস্যার সমাধান
২০. খেলাধুলার জন্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

কিন্তু যশোরের জনগণের এ দাবির প্রতি সরকারের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যশোরবাসীও এইসব অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। ফলে অন্য জেলার তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে।

এক্ষেত্রে বগুড়া, রংপুর, বরিশাল, নোয়াখালী, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা ও ময়মনসিংহ জেলা যশোর থেকে বহুদূরে এগিয়ে গেছে। গত তিন দশকে এসকল জেলা সরকারের কাছ থেকে বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকেল কলেজ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শিক্ষাবোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, শহরের আধুনিকায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে।

১৭৮৬ সালের বাংলার অন্যতম প্রাচীন জেলা যশোর দেশ ও জাতির উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখে চলেছে সেই হিসেবে এই অঞ্চল উন্নয়নের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। বেনাপোল বন্দর থেকে প্রতি বছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পায় সরকার। এ ছাড়া কৃষি ও শিল্প খাত থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা আয় হয়। অথচ বৃহত্তর যশোর থেকে অর্জিত এই অর্থ এ অঞ্চলের উন্নয়নে খুব সামান্যই ব্যয় করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় তাহলে কেন উন্নয়ন হচ্ছে না। অন্যভাবে বললে বলতে হয় বৃহত্তর যশোরবাসী বিভিন্ন অধিকার আদায়ের দৌঁড় প্রতিযোগিতায় সামনে থেকেও কেন পিছনে পড়ে গেছে। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তা স্পষ্ট চোখে পড়ার মতো।

আমার কাছে মনে হয় এরজন্য বেশ কয়েকটি কারণ দায়ী।

১. স্বাধীনতা পরবর্তী যেসকল সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের নীতিনির্ধারক মহল যশোরের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। তা না হলে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অন্যান্য জেলার উন্নয়ন হয় কী করে?

২. সরকারের মন্ত্রিপরিষদে বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ অঞ্চলের মানুষের গুরুত্ব সব সময় কম থাকে।

৩. বৃহত্তর যশোরের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছে দলীয় সংকীর্ণতা। আমরা প্রায়ই দেখি অন্যান্য জেলার রাজনৈতিক নেতারা দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সঙ্কটকালেও নিজ জেলার উন্নয়নের স্বার্থে এক মঞ্চে বসে এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী এবং অরাজনৈতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। কিন্ত এমন চিত্রটি যশোরে ক্ষেত্রে সচারাচর তেমনটা আমরা দেখতে পাই না। সকল দল মিলে এলাকার উন্নয়ন করবে এমন মনোভাব আজও এই আধুনিক শিক্ষিত সমাজে এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগেও সৃষ্টি হয়নি।

৪. যশোরের উন্নয়নের ব্যাপারে এখনো কোনো প্রভাবশালী জনমত গড়ে ওঠেনি। অথচ অন্য জেলার জনগণ আন্দোলন করে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন নজির অংসখ্য রয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি,সমাজসেবক,পেশাজীবী সংগঠন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঠিক নেতৃত্ব দানের অভাবে আমরা তা পারিনি। তারা দলীয় স্বার্থের ব্যাপারে একতাবদ্ধ হলেও সমগ্র জেলার উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধ নন।

৫. ইদানিং কালে আমাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবটা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একারণে আমরা কখনোই নিজস্ব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবছি না। ফলে আমরা দিনদিন পিছিয়ে যাচ্ছি।

৬. সিলেটের জেলার মানুষের মাঝে সিলেট্টা, নোয়াখালীর জনগণ ভাবে আমরা নোয়াখাইল্লা কিংবা বরিশালের লোকজন নিজেদেরকে বরিশাইল্লা মনে করে। এই চেতনা বা মনোভাবের মাধ্যমে তাদের ভিতরে ঐক্যবোধের একটি মানসিক চেতনা সৃষ্টি হয়। যার ফলে তারা তাদের দাবি বা অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে একতাবদ্ধ হয়ে তা আদায় করে নেয়। এই ঐক্যবোধ চেতনা যতদিন যশোরবাসীর মধ্যে সৃষ্টি না হবে ততদিন আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারবো না।

৭. সংবাদপত্রে লেখেন এমন শক্তিমান লেখকের বাড়ি যশোরে থাকলেও তারা যশোরের সমস্যা, উন্নয়ন ও সম্ভাবনা নিয়ে কলম ধরেন কম। ৭. অনেকেই যশোরের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও আমরা তাদেরকে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করি না। এই মনোভাবও যশোরের অনুন্নয়নের পিছনে দায়ী।

প্রিয় পাঠক। আমি যেসব কারণ তুলে ধরেছি তা অনেকের মতের সাথে মিল নাও থাকতে পারে। কারণ একেকজনের চিন্তাভাবনা একেক রকমের। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও ভিন্ন। আবার সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্যও নয়। তবে একথা র্নিদিধায় স্বীকার করতে হবে যশোরে এমন অনেকই রয়েছেন যারা সর্বদা জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ।

যশোর একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ। উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী। যশোরের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে এক হয়ে কাজ করতে পারলে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব হবে। আসুন,আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, মতদ্বৈততা ঝেড়ে ফেলে যশোরের উন্নয়নে সোচ্চার হই। যশোর আবারও হয়ে ওঠুক সকল ক্ষেত্রে সমৃদ্ধশালী। এর যশ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।

লেখক পরিচিতি :
বি এম ইউসুফ আলী
কলামিস্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক;
[email protected]