শো অফ নিয়ে দুটি কথা

আভিধানিক অর্থে সমষ্টিগত কিংবা নিজের কোনো কিছু কাউকে দেখাতে চাওয়া বা জানাতে চাওয়া অথবা কোনো ক্যালকুলেটিভ ড্রিম কিংবা লক্ষের প্রেজেন্টেশন হলো শো অফ। অনলাইন দুনিয়ার যার অবস্থান তুঙ্গে। প্রথমত বলবো, কোনো দীর্ঘমেয়াদী কাজের প্রারম্ভে এর গন্তব্য উপস্থাপন করাই হচ্ছে উত্তম শো অফ। এর পজিটিভ দিক হলো, আপনি যেটা শো অফ করেন সেটা বাস্তবায়নের জন্য উদগ্রিব হয়ে পড়েন বিকজ ব্যর্থ হবার লোকলজ্জা ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে লেগে থাকতে শক্তি দ্বারা তাড়িত করে।

তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ততটুকই শো অফ করা উচিত যতটুকু আপনি কয়েক মাস অথবা লক্ষের ধরন অনুযায়ী কয়েক বছর কাজ করেই অর্জন করে ফেলতে পারেন। নচেৎ লম্বা সময় আপনাকে ব্যর্থতার মোড়কে দেখলে গণমহলে তার দুয়োধ্বনি উঠে আপনাকে ডিমোটিভেটেড করে দিতে পারে আপনি যদিও সফলতার খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন। অর্থাৎ এ ধরনের শো অফ হচ্ছে নিজেকে নিজেই একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দ্রুত সফল হওয়ার জোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া।

আরো পড়ুন :
মোংলা, পায়রা বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
পিএইচপি কোরআনের আলো প্রতিযোগিতায় সেরা ১০ বেনাপোলের হাফেজ আবু সাঈদ
সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডব শুরু

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যক্তি পর্যায়ে শো অফ- আমি ওমুক দিনে বা এতদিন পর একটি প্রাইভেট কার কিনবো। দলীয় শো অফ- আমরা এবারের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবো। রাষ্ট্রীয় শো অফ- আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, ইত্যাদি বাস্তবায়ন করবো। সবগুলোই Advanced & positive Show off. যা ব্যক্তি দল কিংবা রাষ্ট্রের উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভূমিকা রাখে।

দ্বিতীয়ত বলবো কৃতকর্মের শো অফ নিয়ে, আপনি বা আপনারা যে কাজটি ইতোমধ্যে সম্পাদন করেছেন তা যদি সামষ্টিক কাজ হয় তাহলে অফিশিয়াল প্রচার করুন। যদি সেটা কল্যাণমূলক কাজ হয় এমনিতেই ছড়িয়ে পড়বে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। এমনকি কাল হতে কালান্তরে। আর যদি নিস্ফল কিংবা কল্যাণহীন কাজ হয় তবে তো সেটা শো অফের যোগ্যতাই হারালো। আর ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদিত কাজ অথবা কোনো গুণ চারপাশের লোকেদের কাছে seen at first time এ যদি মানসিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হয়ে না ওঠে তবে সেটা নিজের ঢোল নিজে পেটানোর ব্যকরণে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

পক্ষান্তরে ব্যক্তিগত গুণসমূহ জনমনে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব প্রকৃতি নিজেই গ্রহণ করে থাকে। যেমন মার্জিত লাইফ স্টাইল, সুশিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন, দানশীলতা, ভালো গাইতে পারা, সুন্দর করে বলতে পারা, ইত্যাদি। আপনার চারপাশের মানুষকে যেটা আপনা আপনিই প্রভাবিত করে এবং দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে বড় পরিসরে, সেটা তখন শো অফ বলে গণ্য না হয়ে বরং ডিরেক্ট খ্যাতি হিসেবে প্রাধান্য পেয়ে যায়। অর্থাৎ এসব গুণ থেকে থাকলে শো অফের প্রয়োজনই পড়ে না। বরং সময় এবং প্রকৃতি সঠিক সময়ে খ্যাতি এনে দেয় এমনিতেই। আর কোনো কাজে ইতোমধ্যে সফল হয়ে গেছেন বিষয়টি যদি এমন হয় তাহলে কমার্শিয়াল প্ল্যাটফর্মে কিছুটা সেলফ ব্র্যান্ডিং প্রয়োজনের জন্যই প্রয়োজন।

কোথায় শো অফ করতে পারেন নির্দ্বিধায়, ১. যে শো অফ ব্যক্তি কিংবা দলকে কর্মোদ্যম করে। ২. যেখানে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায় শো অফের মাধ্যমে। তাহলে কোথায় কোন কাজে শো অফ অনুচিত, Person to organisation/ person to welfare fund/ person to state. অর্থাৎ যে দান বা অবদান ব্যক্তি থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যম হয়ে আবার কোনো ব্যক্তি কল্যাণে ফিরে আসে বা প্রদান করা হয় তাদের অধিকার স্বরূপ।

যেমন জাকাতের টাকা (Islamic tax) রাষ্ট্র সংগ্রহ করে তা জনকল্যাণে ব্যয় করা হলে সেটা শো অফ করা যেতে পারে চাইলে। কিন্তু সে টাকা ব্যক্তি তার বাড়ির সামনে লম্বা সারি মেইনটেইন করে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রদান করলে সেটা হয় গ্রহীতার জন্য লজ্জার। আবার ধরুন আপনি ধর্ম প্রচার-প্রসারের স্বার্থে মসজিদ মাদ্রাসায় সহযোগিতা প্রকাশ্যেই করতে পারেন শো অফ করে, তাতে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়ে (সেটা অবশ্য অহমিকা বর্জন করে)। কিন্তু ওই মসজিদের কোনো অভাবগ্রস্ত মুসল্লিকে দিয়ে নয়। কারণ সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে দান, যা গ্রহণের সাথে আত্মসম্মান জড়িত। জাকাত আর ঐচ্ছিক দান সাদকা একই বিষয় নয়।

কখন শো অফ আরও বেশি বেমানান- প্রথমত : প্রাপ্ত / প্রদত্ত দায়িত্ব কিংবা কর্তব্য কাজে শো অফ বড্ড বেমানান। যেমন, পুলিশ আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখবে, নেতা জনগণের সেবা করবেন, ডাক্তার অবকাশ যাপনে না গিয়ে ওটিতে যাবেন, সন্তান তার মা-বাবাকে দেখবেন, সক্ষম ব্যক্তি তার অক্ষম প্রতিবেশির পাশে দাঁড়াবেন এ গুলো তো তাদের জন্য নরমাল ফ্যাক্ট। অথচ সেগুলো যদি অতিমাত্রায় শো অফ হয়ে যায় তবে তা অনিয়মের মাঝে নিয়ম মানা বা অকেশনাল উৎসবের মতো দেখায়, ঠিক যেন বাঙালি হয়েও শখ করে একদিন পান্তা খাওয়া বা লুঙ্গি পরার মতো, যা আবার আমাদের নিত্য কর্ম বলেই স্বীকৃত। তবে হ্যাঁ বিরল কিছু ঘটলে কংগ্রাচুলেশনস কিংবা রিঅ্যাওয়ার্ড দেয়া-নেয়ার বিষয়টি অসুন্দর নয়। দ্বিতীয়ত : দান দাক্ষিণ্যের বেলায় Person to person/ Institute or organisation to person এর বেলায় অবশ্যই শো অফ নয়। বিকজ এটা দান গ্রহীতার জন্য আত্মসম্মানহানিকর। ঐশী ধর্ম ইসলামেও তেমনটিই নির্দেশিত যে, ডান হাতের দান যেন বাঁ হাতেও বুঝতে না পারে।

ওপরেই বলেছি, কোনটা শো অফ করা যাবে আর কোনটা করা অনুচিত হবে। মোদ্দা কথা হলো, মানবতা ও ভালোবাসায় শো অফ নয়। এটা সব সময়ই ফ্লপ সিনেমার মতো দেখায়। বিকজ মানবতা ও ভালোবাসা শব্দ দুটি দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার শব্দগুলোর সমষ্টি।

লেখক : মো. আক্তারুজ্জামান
সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ ট্রেনার, এক্সিলেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার।

মে ২০, ২০২০ at ১১:৩৬:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরএস/এএডি