হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন?

শিরোনামটা মনে হতে পারে হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনায় ব্যাখ্যা দিতে এসেছি, আসলে তা নয়। অনেকের মতো উত্তরটা আমারও জানা নাই। তাই শিরোনামে প্রশ্নটা রেখে কিছুটা প্রাসঙ্গিক কথা বলার চেষ্টা করবো। খাদ্য ও চিকিৎসা দুটোই মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। খাবারের পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থাটাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কিন্তু মিলছে না কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা। করোনাযুদ্ধের প্রথম সারির যোদ্ধা চিকিৎসকেরা, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ নাই। আর সেই চিকিৎসকরাই আবার কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের মহান কর্মযজ্ঞকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন। তবে এটি আসলেই চিকিৎসকদের অবহেলা, নাকি এই করোনাকালের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও সমন্বয়হীনতা? সঙ্গত কারণে এ রকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। শনিবার (৯ মে) রাজধানীর সাতটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। বাবার এই মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক মেয়ের কথায় উঠে এসেছে চিকিৎসা ব্যবস্থার করুণ চিত্র। এখান থেকেই বোঝা যায়, চলমান চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে অন্য সাধারণ রোগীদের কী অবস্থা।

একদিকে পথেঘাটে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মানুষের চোখের সামনে মানুষ ছটফটিয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকছে। যেখানে উৎসুক মানুষজন পুরোপুরি নীরব দর্শক হয়ে মানুষের মৃত্যুদৃশ্য ‘উপভোগ’ করছে। তাদেরকে করোনার ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মনে করে সংক্রমিত হবার ভয়ে নিথর দেহের কাছেও এগিয়ে যাচ্ছে না কেউ। এ রকম বেশ কয়েকটি মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে বেরিয়েছে। প্রসঙ্গ এড়িয়ে এখানে আরেকটু বলা যায়, উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে না। উপসর্গে মারা যাওয়া মানুষের পাশেও ভিড়তে সাহস করছে না মানুষ। অথচ নিরাপদ দূর থেকে মৃত ব্যক্তিকে দেখার জন্য ‘উৎসাহের’ কমতি নাই উৎসুক মানুষের। এমনকি স্বজনদের বেলায়ও ঘটছে একই রকম ঘটনা। বাবা-মা, ভাই-বোন যেই হোক কেউ কারো কাছে ভিড়ছে না, এমন খবরও দেখা যাচ্ছে। কেউই অচ্ছুত নয়, শুধুমাত্র সংক্রমিত হবার ভয়। যা মানবিকতার চরম বিপর্যয়।

এবার প্রাসঙ্গিক কথায় আসি, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বিনা চিকিৎসায় রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার খবর অহরহ আসছে গগণমাধ্যমে। স্বজনরা রোগীকে নিয়ে এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল ছুটে বেড়াচ্ছেন। চিকিৎসা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রোগীরা মারা যাচ্ছেন। অনেক স্বজন রোগীদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। রোগীদের নিয়ে এ রকমের ভোগান্তির শেষ নাই স্বজনদের। এ অবস্থায় দরিদ্র শ্রেণির মানুষগুলোর চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি আরো নাজুক হয়ে পড়ছে। তাদের ভরসার জায়গা সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় হতাশাকে সঙ্গী করে সৃষ্টিকর্তার কৃপা প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকছে না। বিনা চিকিৎসায় ফিরতে হচ্ছে বাড়িতে। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার এই বেহালদশা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

গত বৃহস্পতিবার (৭ মে) একদিনেই চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার তিনটি অমানবিক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। করোনাকালের অমানবিক এমন ঘটনার একটি ঘটেছে গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়। হতভাগ্য ছেলেটির নাম ইউসুফ হোসেন (১৫)। সে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় লেগুনা পরিবহনের হেলপার ছিল। ওই এলাকায়ই ভাড়া থাকতো সে। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার মান্দাইটায়। পিতার নাম সাহামুদ্দিন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ওই দিন ইউসুফের বমি ও পাতলা পায়খানা হলে বাড়িওয়ালার নিকট থেকে ১৫০ টাকা ভাড়া নিয়ে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায় সে। ওই হাসপাতালটি করোনা ডেডিকেটেড হওয়ার কারণে চিকিৎসা না পেয়ে অন্য কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে তারা করোনা রোগী ভেবে তার চিকিৎসা দেয়নি। পরে একটি ভ্যানে করে টঙ্গীতে আহসান উল্লাহ জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পথে চান্দনা এলাকায় একটি সিএনজি স্টেশনের সামনে ভ্যানের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভেবে ভ্যানচালক রাস্তার ওপর তার মরদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় রাস্তার আশপাশের লোকজনও এগিয়ে আসেনি। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ গিয়ে ওই ছেলেটির লাশ উদ্ধার করে পরিচয় শনাক্ত করে। পুলিশ তার পরিবারের লোকজনকে খবর দিলে তারাও আসতে দেরি করে। পরে গাজীপুর মহানগরের ইটাহাটা কবরস্থানে ইউসুফের লাশ দাফন করেন পুলিশ সদস্যরা।

বৃহস্পতিবার অপর একটি অমানবিক ঘটনার শিকার হয়েছেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ার এক নারী। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ছয়টি হাসপাতালে সারাদিন ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা রেবেকা সুলতানা চৌধুরী। করোনা ভাইরাস নেই- এমন নথি দেখাতে না পারাসহ নানা অজুহাতে ওই নারীকে কোনো হাসপাতালেই ভর্তি রাখা হয়নি। করোনা পরীক্ষার জন্য সরকারি তিনটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য বাতায়নের ৩৩৩ নম্বরে স্বজনরা বারবার ফোন দিলেও সাড়া মেলেনি। শেষ পর্যন্ত ৯ ঘণ্টা ধরে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে ওই দিন বিকাল ৫টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান তিনি।

স্বজনরা গণমাধ্যমকে জানান, রেবেকা সুলতানা চৌধুরী অসুস্থ হওয়ার পর তাকে নিয়ে তারা বিআরবি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, বারডেম হাসপাতাল, আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে (বর্তমানে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) গিয়েছিলেন। পরীক্ষার জন্য মুগদা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছিলেন। কোনো হাসপাতালই রোগীকে ভর্তি করেনি। করোনার পরীক্ষাও করাতে পারেননি তারা।

বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে ভোরের কাগজের সাংবাদিক আসলাম রহমানের পরিবারকে।

করোনার উপসর্গ নিয়ে ওই দিন রাতে ভোরের কাগজের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার আসলাম রহমানের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি শ্বাসকষ্টসহ করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় তিনি নমুনা পরীক্ষা করান। আগের দিন বুধবার পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু পরের দিন বৃহস্পতিবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে তাকে রাজধানীর ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখে করোনা সন্দেহ হওয়ায় ওই হাসপাতাল তাকে ভর্তি করেনি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এর আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়ার অ্যাম্বুলেন্স পেতেও বেগ পেতে হয় পরিবারকে, বলেছেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। পরে ভোরের কাগজের গাড়ি পাঠিয়ে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।

মহামারি করোনা ভাইরাসের এ সময়ে শনিবার (৯ মে) আরেকটি অমানবিকতার শিকার হয়েছেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। তিনি কিডনি অসুস্থতাজনিত কারণে রাজধানীর সাতটি হাসপাতাল ঘুরে মারা গেছেন। তার মেয়ে সুস্মিতা আইচ নিজেও একজন চিকিৎসক। সরকারের স্বাস্থ্য সেবা ৩৩৩ হটলাইন নম্বরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তবে বাবাকে রাজধানীর কোনো নামিদামি হাসপাতালেই ভর্তি করাতে পারেননি। যে হাসপাতালেই গেছেন সেখান থেকে ফেরত আসতে হয়েছে। অবশেষে বৃহস্পতিবার গৌতম আইচকে ভর্তি করা হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে। এরপর শনিবার (৯ মে) দুপুর ১২টার দিকে অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের মৃত্যু হয়।

ডা. সুস্মিতা আইচ গণমাধ্যমকে বলেন, বাবার করোনার উপসর্গ ছিল না। কোনো উপায় না পেয়ে অনেক কষ্টে বাবাকে কুর্মিটোলায় ভর্তি করাই। বাবার আইসিইউ সাপোর্টটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হলো না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না। তিনি আরো বলেন, বাবাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কি না, তা জানার চেষ্টাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেনি। অথচ বাবা মারা যাওয়ার পর তারা (কুর্মিটোলা হাসপাতাল) বলছে, আগেই নমুনা নেয়া দরকার ছিল। ডা. সুস্মিতা বলেন, বাবার এই অবস্থায় হাসপাতালগুলো চাইলেই তাকে ভর্তি নিতে পারতো। কোভিড-১৯ সন্দেহ হলে প্রয়োজনে আইসোলেশনে রাখতে পারতো, কিন্তু কেউ সেটা করেনি। আমি যে হাসপাতালেই গিয়েছি সবাই বলেছে, টেস্ট (রিপোর্ট) আনেন। আমি টেস্টটা কোথায় করাব? আমি কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই বোঝাতে পারলাম না বাবা করোনারোগী নন।

এর কয়েকদিন আগে তৃতীয় মাত্রায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন চিকিৎসা না পেয়ে করোনায় বাবা হারানো এক তরুণী। মূলত নিজের অভিজ্ঞতার কথা দেশবাসীকে জানানোর জন্যই ওই তরুণীকে তৃতীয় মাত্রায় আনা হয়। তিনি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরো ভয়াবহ চিত্র। তার বাবাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর ১২টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরতে হয়েছে তাকে। একজন রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর আচরণের চিত্র ফুটে উঠেছে বাবা হারানো ওই তরুণীর কথায়। তার কথায় প্রশ্ন উঠেছে আইইডিসিআরের প্রতিদিনের করোনা আপডেট নিয়েও। তার বাবা করোনায় মারা যাওয়ার বিষয়টি আইইডিসিআরকে জানানো হলেও তারা নমুনাও সংগ্রহ করেনি। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে তার নমুনায় পরীক্ষার ফল পজিটিভ ছিল। অর্থাৎ আইইডিসিআরের প্রতিদিনের ২৪ ঘণ্টার হিসাবে তার বাবার মৃত্যুর তথ্য ছিল না বলে দাবি করেন ওই তরুণী। এ রকমভাবে আরো অনেক তথ্যই আইইডিসিআরের অগোচরে থেকে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া এবং দুস্থ, অসহায় মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়া যেমন জরুরি, তেমনিভাবে তাদের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়টাও নিশ্চিত করা জরুরি। খাদ্য সংকটে সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা সংকটে মৃত্যুর মিছিলও লম্বা হতে থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অপ্রতুল হলেও অসহায়দের খাবার দেয়া হচ্ছে, কিন্তু হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না- এ রকম দ্বিমুখী ব্যবস্থাপনার খবর পাওয়া যাচ্ছে অহরহ। কিন্তু করোনার সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তারদের কাছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এই আচরণ কারোরই কাম্য নয়। নগর-মহানগরের বাইরে সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনাকালের চিকিৎসাসেবায় একই অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরও এই সংকটের বাইরে নয়।

এ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও রোগীদের সঙ্গে ঘটছে এমন নিষ্ঠুর আচরণের ঘটনা। যে কোনো রোগী সেখানে গেলেই ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, অথবা রোগীকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের চিকিৎসা মিলছে না- এমন খবর সবখানে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে বিড়ম্বনা এড়াতে সেখানে যেতেই চাচ্ছে না। ফলে রোগীশূন্য হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। আর এখানকার চিকিৎসকরা নভোচারীর মতো করে করোনার সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে নিজেরা নিজেরা খোশগল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্যদিকে তাদের করোনা উপসর্গের নমুনা সংগ্রহের কথা বলাই বাহুল্য। একজনের নমুনা নিতেই ৩-৪ ঘণ্টা সময় পার করে দিচ্ছেন এখানকার এই গল্পবাজ চিকিৎসকরা। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এখানকার দুই চিকিৎসক জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে তাদের সব ধরনের ব্যবস্থাপনা রয়েছে বলে দাবি করলেও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি উল্টো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী বলছে : সরকারি হোক বা বেসরকারি, যে কোনো হাসপাতালে করোনা সন্দেহভাজন রোগী এলে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানাতে হবে। গত ৩০ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ রকম একটি নির্দেশনা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে কোনো মুমূর্ষু রোগী কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত বলে যদি সন্দেহ হয়, কোনো কারণে ওই হাসপাতালে ভর্তি করানো যদি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের চারটি নম্বরের যে কোনোটিতে ফোন করে ওই রোগীর চিকিৎসা বা ভর্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নিতে হবে।

করোনার লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোগী ও তাদের স্বজনের কাছ থেকে এমন বেশকিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই নির্দেশনা জারি করে বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পরেও হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো ওই নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ওই নির্দেশনার অর্থ এই নয় যে, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে। আমরা বলেছি, রোগী করোনা সন্দেহভাজন হলে তাকে একটি কর্নারে বসিয়ে রেখে হটলাইনে ফোন করতে হবে। তারপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে, কোন হাসপাতালে ওই রোগী ভর্তি করা যায়। করোনা সন্দেহভাজন হলে তাকে আইসোলেশন ইউনিট আছে, এমন হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। করোনা মনে না হলে তাকে রোগের ধরন অনুযায়ী অন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। এতে করে রোগীকে ঘোরাঘুরি করে হয়রানি হতে হবে না। যেসব হাসপাতাল নির্দেশনা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

কিন্তু আসলেই কী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে?। এক বাক্যে বলে দেয়া যায়, মোটেও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসছে। পাশাপাশি এও গণমাধ্যমে আসছে, হটলাইনেও ঠিকমতো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আর কোনো মতে যোগাযোগ করা গেলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না। সুতরাং মহাপরিচালকের ওই বক্তব্য খাটছে না।

আলোচিত মাস্ক কেলেঙ্কারির কথা বাদ রেখেই বলি, দেশে একদিকে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। অন্যদিকে ‘লকডাউন’ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সরকার শর্ত সাপেক্ষে নির্ধারিত সময় বেঁধে দিয়ে মার্কেট খোলার অনুমতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে মসজিদও খুলে দেয়া হয়েছে। মার্কেট খুলে দেয়ার সরকারি ঘোষণা আসার আগেই সারাদেশে বাজারঘাটে যে পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে তা করোনা সংক্রমণ বিস্তারের জন্য বড় ধরনের শঙ্কার। মসজিদগুলোতে সরকারি নির্দেশনা মেনে সুশৃঙ্খলভাবে মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে দেখা গেলেও বাজারঘাটের বিপরীতমুখী অবস্থা খুবই হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।

গত বছর রোজা নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেলেও এ বছর ৩০টি রোজা পূর্ণ হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। সেই হিসাবে ঠিক অর্ধেক রোজার শেষে রোববার (১০ মে) সারাদেশে মার্কেট খুলে দেয়া হয়েছে। যদিও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জরিপ বলছে, ৯৩ ভাগ মানুষ এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মার্কেট খোলার পক্ষে নয়। পোশাক শিল্পের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে এর আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার কথা বলা হলেও অধিকাংশ কারখানায় সেই বিধি-নিষেধ মানা হচ্ছে না। এবার ঈদমার্কেট খুলে দেয়ার আগেই যে হারে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে তাতে সরকারের বেঁধে দেয়া শর্ত মানা হবে বলে মনে হয় না। করোনাচাষের আরেক ঊর্বর ক্ষেত্র হতে পারে মার্কেটগুলো। যা নতুন করে অশনিসংকেত বহন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

কোন পথে হাঁটছি আমরা কেউই কিছু বলতে না পারলেও সেই পথ যে মসৃণ নয় তা সবাই এক বাক্যেই বলবেন। করোনার মহামারি রোধে আসুন অামরা আরেকটু ধৈর্য্য ধারণ করি। করোনা যখন সবকিছুতেই ব্যতিক্রম ঘটাচ্ছে, এলোমেলো করে দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে আসন্ন ঈদকেই বা বাদ দেবে কেন। করোনাযুদ্ধের অংশ হিসাবে এবারের ঈদটা আমরা ঘরে বসেই ভিন্নভাবে উদযাপন করবো। বিত্তবান, সামর্থ্যবানরা আপনার আশপাশের অসহায় মানুষগুলোকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন। আর করোনার ভয়াবহতাকে উড়িয়ে দিয়ে যারা কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাচ্ছেন, বোঝাই যাচ্ছে আপনাদের মনে অনেক রঙ, অনেক অানন্দ, টাকা পয়সারও কমতি নাই। তাই দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্যে একটু সহানুভূশীল হয়ে তাদের দিকে সহায়তায়ও নজর দিন।

পুনশ্চ : একটা মানুষ যদি ডাক্তারদের সুস্পষ্ট উদাসীনতা, অবহেলার শিকার হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারাই যান, তাহলে ত্রাণের খাবার দিয়ে কী হবে তার। এ অবস্থায় আগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে বাঁচাতে হবে, তারপরেই তো খাবারের প্রশ্ন। করোনাকালের এই রূঢ় বাস্তবতায় ক্ষুধার্ত মানুষের যেমন খাবার দরকার, তেমনিভাবে অসুস্থ মানুষেরও চিকিৎসা দরকার। খাবার এবং চিকিৎসা দুটোই খুব জরুরি। কিন্তু তা উপেক্ষিতই হয়ে আসছে। এই মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তারদের উদাসীন মনোভাব ছেড়ে রোগীদের চিকিৎসার ওপর মনোযোগ দিতে হবে। শুধু ক্যামেরার সামনে আমাদের এই আছে ওই অাছে বলে দায় এড়ানো বক্তব্য দিলে চলবে না। আর এই ওই যখন আছেই তাহলে সেগুলো কাদের জন্য, কীভাবে আছে সেটাও স্পষ্ট করতে হবে।

লেখক : এস আর সেলিম, সংবাদকর্মী।