চলে গেলেন সেই মানুষই কষ্টে যখন দেশটা: মোমিন মেহেদী

‘বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে অবিরত তিনি
এগিয়ে গিয়ে করে গেছেন এই জাতিকে ঋণী
বিনয় নিয়ে আলোর পথিক করে গেছেন চেষ্টা
চলে গেলেন সেই মানুষ-ই কষ্টে যখন দেশটা
তাঁর জন্য নিবেদিত তৈরি আমার মন
‘স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে চলা প্রয়োজন’
এমন কথা বলে বলে এগিয়ে চলার দীক্ষা
রেজা স্যার-ই দিয়ে গেলেন নিবেদিত শিক্ষা।’

শিক্ষাপথে তিনি তৈরি ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। আলোর মানুষ জাতীয় অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা বলছি, চলে গেলেন যিনি করোনাকালে-লকডাউনে। শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, সড়ক ও সেতু বিশেষজ্ঞ সহ অনেক পরিচয়ের মধ্যে জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন গুণী মানুষ। নিরহংকার ও সদালাপী মানুষের মূর্ত প্রতীক। আমাদের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বিনয় আর ভালোবাসা-শ্রদ্ধা। জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন নতুন প্রজন্মের পথের দিশা। ইতিহাস বলে যে, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল, কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে তিনি কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং বিষয়ের উপর পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটে যোগ দেন।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় শিল্পব্যাংক ভবনের ডিজাইনে প্রথম যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় সব বড় অবকাঠামোর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। জীবনের শুরুতে তিনি বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর বৃটেনে উচ্চশিক্ষা শেষে আবার বুয়েটে ফিরে যান। বুয়েটে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্নে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ২০০০ সালের দিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্র্যাক দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সবশেষ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

একুশে পদক প্রাপ্ত জাতীয় ব্যক্তিত্ব জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল সহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি এবং ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সভাপতি। তিনি জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন৷ তার পিতা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মাতা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পিতার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার শৈশবকাল কেটেছে। তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে।

১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার সিলেটে ফিরে আসেন। এরপর তার পিতা বদলি হয়ে ময়মনসিংহে চলে যান। তিনি ১৯৫৭ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে আই্এ, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ট হই ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশে প্রথম বারের মত অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রশিকা। সহযোগিতায় ছিল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার। ৫ আগস্ট হোটেল শেরাটনের বল রুমে অুনষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় দেশের প্রায় সবগুলি বিশ্বদ্যিালয় ছাড়াও বিভিন্ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, স্কুল ও কলেজের প্রতিযোগিরা অংশ গ্রহন করেন। ৩ জন করে একেকটি টিম, মোট ৫০টি টিমে ১৫০ জন প্রতিযোগী এতে অংশ নেন। শিক্ষা নিয়ে অনবদ্য এই চেষ্টা আলোর মানুষ ব্যতিত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব না। তিনি দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সবার কাছে আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবেই পরিচিত। গুণী এই মানুষটি যেখানেই হাত দিয়েছেন সফলতা তাঁর সাথে ছিলো জোয়ারের মত। শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশা, নীতিনির্ধারণী সব কিছুতেই দেশকে বহু কিছু দিয়েছেন।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করা এই পুরকৌশলী। ১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল, জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদেরই একজন। দেশের প্রথম মেগাপ্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন নিবেদিত আলোর মানুষ। আর এখন পদ্মার ওপরে দেশের সবচেয়ে বড় যে সেতু তৈরি হচ্ছে, সেই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেরও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি। যতদূর জানি- ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দলপতি তিনি। একুশে পদক পাওয়া এই শিক্ষককে ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন। একই সঙ্গে আমৃত্যু তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর। সিলেট শহরে প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী ও হায়াতুন নেছা চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবার বদলির চাকরির কারণে তার শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রাথমিক শেষ করে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হলেও পরে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। প্রথমে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরে সেইন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। শিক্ষায় অনন্য মানুষ-সফল মানুষ ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখনকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ)। ১৯৬৩ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে দেশের সেরা এই প্রকৌশল বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা শুরু করেন। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৬৮ সালে সেখানেই পিএইচডি শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘শিয়ার ওয়াল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং’। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আবারও বুয়েটে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি। পদোন্নতির ধারায় ১৯৭৬ সালে হন অধ্যাপক। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০০১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। বিশেষজ্ঞ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়েও সরকারের বিভিন্ন পরামর্শক প্যানেলে জামিলুর রেজা চৌধুরীর ডাক পড়ে। ২০০১ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর আইটি টাস্কফোর্সেরও সদস্য করা হয়।

ভালোবাসা-সুন্দর ও স্বচ্ছতার সাথে বহুতল ভবন নির্মাণ, স্বল্প খরচে আবাসন, ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নকশা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে ইমারত রক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রকৌশল নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৭০টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তার। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে সরকার তাকে একুশে পদক দেয়। ২০১৮ সালের জুনে আরও দুজন শিক্ষের সঙ্গে তাকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করা হয়। ওই বছরই জাপান সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানজনক ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন’ খেতাবে ভূষিত করে। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশিও তিনি। ঋণী করে যাওয়া আলোর মানুষ, সুন্দরের প্রদর্শক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর হঠাৎ এই চলে যাওয়া আমাকে করেছে ব্যথিত। তাঁর সাথে যে কয়বার দেখা হয়েছে আমার, ততবার তিনি নির্মাণ করেছেন নতুন প্রজন্মের পথচলার নির্দেশনা। দেখিয়েছেন- বায়ান্ন-একাত্তর-নব্বইয়ের বীরদের মত করে এগিয়ে চলার পথ। তাঁর চলে যাওয়া যেন আমাদের পাথেয় হয়, হয় শোকে কাতরতার সাথে সাথে তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি