একজন সাহসী যোদ্ধার গল্প ……

একজন সাহসী যোদ্ধার গল্প বলি আজ, যার জীবনগল্প আমাদের অনেক কিছু শেখাতে পারে… ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ তাঁকে সম্মান জানান তাঁর শিল্পকর্মের স্বীকৃতি সরূপ| তাঁর গল্প কেন আজ এই দিনে বেছে নিলাম আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্য, তা পুরো লেখাটি পড়লে অনুধাবন করা যাবে!

এই মায়ের নাম এলিসন লেপের, তিনি একজন শিল্পী, যার দুটো হাত এবং পা নেই। লন্ডনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত Trafalgar Square এ তিনি মডেল হয়েছেন এমন ভাস্কর্য আছে, যা দেখতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ জড়ো হয়। তিনি একটি পুত্র সন্তানের মা হলেন। সন্তান নেবেন কিনা সেই সাহসী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, যদিও তার পার্টনার এর কোনো দায়িত্ব নেয়নি। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁর মা হয়ে উঠার যুদ্ধ! যেহেতু দুই হাত পা নেই, তাই তাকে মা হতে গেলে যা যা করতে হবে তার ট্রেনিং দেয়া শুরু হলো। তিনি পেটে বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন কষ্ট করে সেই ট্রেনিং নিতে গাড়ি চালিয়ে যেতেন। ৯ মাস ট্রেনিং নিলেন এবং সন্তান হবার পর ডাক্তার তাঁকে দেখিয়ে দিলো কিভাবে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সেই দুধ খাওয়ানো হতে শুরু করে বাচ্চার ন্যাপি বদলানো, পরিষ্কার করানো, ডাক্তারের কাছে নেয়া, ভ্যাকসিন দেয়া, জ্বর এলে রাত জেগে ছেলের সেবা করা, সব একাই সামলেছেন, কারণ যিনি বাচ্চার বাবা, তিনি আর খোঁজ নেন নি কখনো।

তারপর বাচ্চাকে হাঁটা শেখানো হতে স্কুলে নেয়া, স্কুল জীবনে ডিপ্রেশনে থাকা বাচ্চাটির সাথে সারাক্ষন সময় দেয়া, জীবন জয়ের গল্প বলা, এই সবই ছিল তাঁর সংগ্রামের গল্প! বিবিসি তাঁর এই প্রতিদিনের সংগ্রামের উপর ডকুমেন্টরি বানিয়েছিলো, বানিয়েছিলো আরো কয়েকজন। ইউটিউবে Alison Lapper দিয়ে সার্চ দিলেই যারা দেখতে চান, দেখে নিতে পারেন এই মায়ের জীবন যুদ্ধের গল্প। এই ছেলের খরচ জুগাতে মা প্রতিনিয়ত করে গেছেন তার কাজ, সাথে শিল্পী হিসেবে বসে থাকেন নি এক মুহূর্তের জন্যও তার শিল্প কর্ম হতে দূরে। এমনকি ছোট্টও ছেলেকে তিনি সাঁতার শিখিয়েছেন অল্প বয়সেই| একজন স্বাভাবিক মা যা যা শেখাতেন তাঁর সন্তানকে, তার কোনটা হতেই ছেলেকে বঞ্চিত করেনি আলিসন| পরম মমতায়, দক্ষ হাতে, বলিষ্ঠ চিত্তে একসাথে ছেলের জীবন, প্রফেশনাল লাইফ এবং তার শিল্পী জীবন সব কিছু সামলেছেন। কিন্তু তবুও জীবন যেন কখনো কখনো অসহায়!

ছেলেটির নাম Parys, কয়েক মাস আগে মাত্র ১৯ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে। ছেলেটির ভেতরে ডিপ্রেশন বলে হয়তো কিছু ছিল। আমরা যারা ভাবি, কেউ আত্মহত্যা করলে সহজেই অন্যের উপর দোষ খুঁজি, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অন্যদের কোনো দোষ থাকেনা, আবার কখনো কখনো থাকে। যেমন এই ছেলেটির ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তার স্কুলের সহপাঠী দুষ্ট এক/দুজন ছেলে তার মাকে নিয়ে বুলিং করতো, যা সে মেনে নিতে পারেনি।

কিন্তু যেই ছেলে এতো বড় যোদ্ধা মায়ের পেটে জন্মালো, সেই ছেলে এই বুলিং মেনে নিতে না পেরে ওভার ডোজ ড্র্যাগ নিয়ে আত্মহত্যা করে! নয়তো এই ছেলেটি জানে তার মা তার জন্য কি না করেছে? অসম্ভবকে সম্ভব বানানোর যে গল্প তাকেও হার মানিয়েছে এই মা! অথচ এই মাকে সে একলা রেখে এই দুনিয়া হতে চলে গেলো! প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী মা তাঁর এই ছেলেটিকে তিলে তিলে বড় করেছেন এই ভাবে চলে যাওয়া দেখতে?

আসলে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা যারা করেন, তাদের বেশির ভাগই আত্মহত্যা প্রবন একটি রোগে ভুগেন। বহির্বিশ্বে এই প্রবণতা কে একটি রোগ হিসেবে বিবেচনা করে নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে আমরা আত্মহত্যা করার যে প্রবণতা একজন ব্যক্তির ভেতরে আছে, তা মানতে চাইনা। এমনকি পরিবারের কেউ আত্মহত্যা করেছে, সেটাও কাউকে জানাতে কুন্ঠিত হই, কিন্তু আমরা যদি এটাকে একটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলেই এই সমস্যা হতে আমরা তাদের বাঁচাতে পারি।

যারা আত্মহত্যা প্রবন মানুষজন আছেন, প্লিজ আপনারা নিজেরা অথবা যদি টের পান আপনার পরিবারের সদস্যদের ভেতরে এই প্রবণতা আছে তবে তাড়াতাড়ি কাউন্সিলিং করানোর জন্য যোগাযোগ করুন মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে। এই প্রবণতাকে অবহেলা করা যাবেনা, এই প্রবনতা যাদের থাকে তারা যেকোনো একটি ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা করে বসে, যেটা হয়তো তার পরিবারের অন্য কারো সাথে ঘটলে পাত্তাই দিতোনা। যেমন এই মা ছেলের ঘটনাই তার প্রমান। ছেলেটি যে কারণেই আত্মহত্যা করুক, আমি নিশ্চিত তার মা এসব সমস্যাকে কখনো কোনো সমস্যায় ভাবেনি, তাহলে এতদূর সংগ্রাম করতে পারতো না। তিনি নিজে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা কালীন সময়ে অনেক বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন, কিন্তু সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের পরিকল্পনা মাফিক গন্তব্যে পৌঁছার স্বপ্ন দেখেছেন… অথচ সুস্থ সবল একটি ছেলে কি করে নিজেকে মুহূর্তেই নিঃশেষ করে দিলো, মায়ের এতো বছরের সকল অক্লান্ত পরিশ্রমকে অবজ্ঞা করে?

কারণ তারা এতদূর ভাবতে পারেনা, তারা ভাবে কেবল নিজেকে নিয়ে, নিজের কোনো এক মুহূর্তের দুর্বল বিষয়কেই তারা মেনে নিতে পারেনা। নিজেকে পরাজিত ভাবে অল্পতেই, সেই পরাজয় হতেই এই ধরণের মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা। তারা ভাবতে পারেনা, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনেই অনেক রকমের কষ্ট আছে, কবি হেলাল হাফিজের ‘কষ্ট নেবে কষ্ট’ কেবল কবির জীবনে নয়, প্রতিটি জীবনে আছে, কেউ সেই কষ্টকে জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে, কেউ নিজেকে পরাজিত ভেবে শেষ করে দেয়। আমাদের পরিবারের সদস্যদের তাদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, তাদের সারাক্ষন কাউন্সিলিং করতে হবে জীবনের ‘আপস এন্ড ডাউন’ নিয়ে, জয় পরাজয়ের গল্প বলে। আসুন ভালবাসি পরিবারের, সমাজের সকলকে বিশেষ করে যাদের দরকার বিশেষ ভালোবাসা, কেয়ারিং, একটু মমতা!

এই Alison Lapper এর মতো একজন যুদ্ধ জয়ী মানুষের গল্পটি বলার কারণ, একদিকে দেখা কত দৃঢ় মানসিকতা থাকতে পারে একজন মানুষের যিনি তাঁর শারীরিক সকল সমস্যাকে তুড়ি মেরে এগিয়ে গেছেন, কিন্তু এই মায়ের প্রতি কটূক্তি/বুলিং সহ্য করতে না পেরে তাঁরই সন্তান ১৯ বছরে থামিয়ে দেয় নিজের জীবন! আমাদের উৎসাহিত করুক ভাল কাজে, ডিজেবল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হউক, এই চাওয়া| আর যারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়েন, তাদের জন্য গল্পটি একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে, এই প্রত্যাশা রইলো| আসুন, সমাজে শারীরিক কিংবা মানসিক ভাবে পিছিয়ে আছেন যারা, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেই আমরা!
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অভিগম্য আগামীর পথে’, সেই পথে তাদের এগিয়ে দিতে আমরা সকলে যেন এগিয়ে আসি আমাদের সবটুকু দিয়ে…।।