সীমান্ত দিয়ে দেদারছে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র, বেপরোয়া সন্ত্রাসীরা

অরক্ষিত মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাহাড়ে দেদারসে ঢুকছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। এতে করেই শান্ত পাহাড়ে অস্থিরতা কোনোভাবেই কাটছে না। থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনায় বছরজুড়েই পাহাড় অশান্ত থাকছে। একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের কাছে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুত। চাঁদাবাজি, দখল ও আধিপত্যের লড়াইয়ে সেখানে প্রায়ই প্রাণ ঝরছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতামপাড়া এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় আটজন নিহত হয়েছেন।

প্রতিবেশী দুটি দেশের অরক্ষিত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী একাধিক গ্রুপের সহায়তায় এসব অস্ত্র ঢুকছে বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শুধু অস্ত্র নয়, আসছে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকও। এসবের সঙ্গে অনেকের স্বার্থ জড়িত থাকায় বাধছে আধিপত্যের লড়াই। সৃষ্টি হচ্ছে সংঘাত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্র ধরা পড়লেও মজুত অস্ত্রের তুলনায় সেগুলো নগণ্য। এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, মিয়নমার-ভারত সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে। সন্ত্রাসীদেরও অবাধ যাতায়াত রয়েছে। সরকারকে চাপে ফেলতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা তৎপর হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, পাহাড় ঘেঁষা সীমান্ত দিয়ে দেদারছে অস্ত্র ঢুকছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত হয়ে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন এ ব্যাপারে সবই জানলেও যেন পেরে উঠছে না।

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপগ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে খনোখুনির অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ে শৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে জনমত তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোরভাবে অভিযান চালাতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। পাহাড় ঘিরে অনেকের স্বার্থ জড়িত থাকায় সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। বান্দরবানে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকা এখন জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার)- এই সশস্ত্র চার গ্রুপ নানাভাবে সক্রিয়। নতুন সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম পার্টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে আছে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া। তাদের সবার সংগ্রহে রয়েছে মারণাস্ত্র। আছে মগ লিবারেশন আর্মি, যারা মগ পার্টি নামে পরিচিত। এর মধ্যে আর্মস ক্যাডারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। তাদের হাতে রয়েছে তিন হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র।

পুলিশ ও গোয়েন্দা তথ্যমতে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে পুরনো অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এম-১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম-১ রাইফেল, একে-৪৭ রাইফেল, একে-২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান), হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, ৭.৬২ মি.মি. এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলের মতো ভয়ংকর মারণাস্ত্র। প্রতিবেশী দুটি দেশ থেকে তারা এসব অস্ত্র, গুলি ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্র আসছে। মাঝেমধ্যে কিছু ধরা পড়লেও তা খুবই সামান্য। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্রের একটি অংশ সমতলের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতেও চালান যাচ্ছে। দুর্গম সীমান্তের কারণে খুব সহজেই সন্ত্রাসীদের হাতে মারণাস্ত্র চলে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮৫ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে কোনো সীমান্তচৌকি (বর্ডার আউটপোস্ট-বিওপি) নেই। ফলে সেখানে বাধাহীনভাবে অস্ত্র প্রবেশ করছে। পাহাড়ি সীমান্তে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে বিওপি স্থাপন করা যাচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন দুর্গম স্থানও রয়েছে, যেখানে কোনো সশস্ত্র হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর পৌঁছতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

জানা গেছে, পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য মাথাব্যথার কারণ ছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতার মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন ঢাকায় এক কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফের জন্ম হয়। ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশের পর ২০ বছর পর্যন্ত একসঙ্গে ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ ভেঙে যায়।

তখন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশ করে। নতুন সংগঠন গঠনকারীরা দাবি করেন, ইউপিডিএফে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে তারা নতুন সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এছাড়া ছোট বড় একাধিক দল, উপদলের কাছেও আছে বিশাল অস্ত্রের মজুত। যাদের কারণে শান্তিচুক্তির সুফল আজও অধরা।

ref: bhorerkagoj