মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ

ছবি- সংগৃহীত।

দেখা যাচ্ছে-সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য তিনটি খারাপ খবর যুগপৎভাবে উপস্থিত। এর মধ্যে একটি তো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, উচ্চতর ও ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি। দ্বিতীয় খারাপ খবরটি হচ্ছে, ‘নিত্যপণ্যের দামে অস্থিরতা’ সৃষ্টির অভিযোগে ৩৬টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের। জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়েছে, কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতির জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন সাইফুল ইসলামের মতো সীমিত আয়ের মানুষ। জীবনযাত্রার ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও সেভাবে আয় বাড়েনি।

এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের বাজারে সবকিছুর দাম এখন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। এ অবস্থার মধ্যে গত কয়েক মাসে সরকার দফায় দফায় পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি আবারো শিল্প খাতে লাগামছাড়া বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের সাধারণ মানুষ এখন চিঁড়েচ্যাপ্টা।

নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতাসহ সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বসবাসরত সীমিত আয়ের মানুষ। বস্তুত বাড়িভাড়া ও সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বর্তমানে অনেক সীমিত আয়ের মানুষের অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তারা জরুরি প্রয়োজনেও সময়মতো চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছেন না। ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যাদের আয় বাড়েনি তাদের জীবনযাত্রার মান কমেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন। যাদের সঞ্চয় নেই তারা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশাহারা হচ্ছেন। বতর্মানে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন। অনেকের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সঞ্চয় ভেঙে ঋণ করতে হয়েছে অনেককে। ব্যাংকগুলোতে কমেছে আমানত। মধ্যবিত্তরা সমস্যায় পড়েছেন বেশি। সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে প্রতি মাসে দুবার ভোজ্যতেল ও ডাল দেয়া হচ্ছে। ওএমএসের মাধ্যমে চাল, আটা সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পরিচালনাও অব্যাহত আছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, চাল, আটা, ময়দা, মাছ-মাংস, তেল, লবণ, সাবান, কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ব্যবহার্য ৫৬টি পণ্যের সবগুলোরই দাম বেড়েছে ২০২২ সালে, যেখানে ৫টি পণ্যের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত শনিবার ক্যাব ‘২০২২ সালে ঢাকা মেগাসিটিতে মূল্যস্ফীতির চাপ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

আরো পড়ুন:
>ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত
>‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রধান হাতিয়ার ডিজিটাল সংযোগ: প্রধানমন্ত্রী

এ প্রতিবেদনে পণ্যের দাম বাড়ার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এ হিসাবটি করা হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের সঙ্গে তুলনা করে। ঢাকায় সাধারণ মানুষ ও নিম্ন আয়ের মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব খাবার খায় ও পণ্য ব্যবহার করে সে রকম ৫৬টি পণ্যের তালিকা করে ক্যাব। যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সংসদে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমতে থাকায় চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, সরকার অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে। এ পদক্ষেপ নেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব দ্রুতই আগের মতো শক্ত অবস্থানে ফিরবে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এ অবস্থায় অনেকের কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গত ৭ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কোভিড পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য এবং গম, ভোজ্যতেলসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির হার সহসা কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।

ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় সারা বছরে টমেটো, গাজর, মটরশুঁটি, শুকনো মরিচ ও পোশাকের দাম বেড়েছে ৬০ দশমিক ৮ থেকে ৭৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। আদা, সবুজ পেঁপে/কলা ও কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে এই হার ৩৮ দশমিক ৬৪ থেকে ৪৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ার এ প্রভাব মোট চালের ওপর খুব বেশি না হলেও ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে চিকন চাল ও ১০ দশমিক ০২ শতাংশ বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম। এই সময়ে গমের আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি। আর এই আটা-ময়দার দামের প্রভাব পড়েছে বিস্কুট, কেকসহ প্রক্রিয়াজাত খাবারের বাজারে।

আরো পড়ুন:
>ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত
>‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রধান হাতিয়ার ডিজিটাল সংযোগ: প্রধানমন্ত্রী

ক্যাবের হিসাবে দেখা গেছে, লবণের দাম সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বাড়লেও নি¤œ আয়ের মানুষের পর্যায়ে এই দামটা বেড়েছে ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ভোজ্যতেলের দামও প্রায় ১৪ শতাংশের মতো বেড়েছে। এছাড়া দাম বেড়েছে মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, সব ধরনের দুধ, চিনি, আদা, রসুন, সাবান, রান্নার জ্বালানি, মশার কয়েলসহ সব পণ্যের। ঢাকা মেগাসিটিতে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় গড় মূল্যস্ফীতি সামগ্রিকভাবে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেশি ছিল।

যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সামগ্রিকভাবে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি ছিল। তবে এর চেয়েও বেশি ছিল খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি।

খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে তা ছিল ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, বাজারে চালের বাজারে একসময় ৫০-৫৫ জন মিলমালিক দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও এখন দুটি গ্রুপের কারণে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

একপক্ষে মিলমালিক, অন্যপক্ষে রয়েছেন চালের বাজারের কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। এরা প্রতিযোগিতা করছে কার আগে কে কিনবে। তিনি বলেন, চালের বাজার এখন মনোপলির স্থলে ডুয়োপলির দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় পণ্যের দাম কখনো কমে না, শুধু বাড়ে। এ কারণে এখানে সরকারের পলিসি থাকা উচিত।

জানুয়ারি ২৭.২০২৩ at ০৯:৪৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর