দৌলতপুরে দুই জলদস্যু বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ চরাঞ্চলের মানুষ

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পদ্মায় দুই জলদস্যু বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও জেলেসহ চরাঞ্চলের মানুষজন। দুর্গম চরের সাঈদ বাহিনী ও উজ্জল বাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়া চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। ফলে পদ্মায় নির্বিঘ্নে নানা রকমের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন জলদস্যু বাহিনী দুটির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তবে এই দুই বাহিনীর মধ্যেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। তারা এখন একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। এর জেরে তারা নিজেরাও খুনোখুনিতে লিপ্ত হতে পারেন বলে সাধারণ মানুষজন অাশঙ্কা করছেন। পুলিশ বলছে, দুই বাহিনীর ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

সম্প্রতি পদ্মার ওপারে প্রতিবেশী উপজেলা রাজশাহীর বাঘায় দৌলতপুরের তিন জলদস্যু চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ পুলিশের হাতে আটকের পর পদ্মায় দস্যুতার খবর নতুন করে আলোচনায় আসে। গেল ১৫ আগস্ট আটক হন সাঈদ বাহিনীর ওই তিন জলদস্যু যুবক। তারা হলেন- দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের গোলাবাড়িয়া গ্রামের বাবু প্রামাণিকের ছেলে মিঠুন আলী (২১), এনামুল হকের ছেলে তুহিন আলী (২২) ও ভাঙ্গা গ্রামের মৃত সলেমান হোসেনের ছেলে মোমিন হোসেন (২৩)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাঈদ বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন দৌলতপুর উপজেলার বৈরাগীর চর এলাকার ভাদু মণ্ডলের ছেলে সাঈদ মণ্ডল এবং উজ্জল বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ভুরকাপাড়া গ্রামের মৃত আলিম সর্দারের ছেলে উজ্জল সর্দার। দীর্ঘদিন ধরে নদীতে অস্ত্রের মুখে মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করে আসছেন এই দুই সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। মাদক চোরাচালান, নদী তীরবর্তী গ্রাম ও চরাঞ্চলের দোকানপাটে চাঁদাবাজি, নদীতে জেলেদের কাছে চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়ীদের ট্রলার বা কার্গো প্রতি চাঁদা আদায় করে আসছে বাহিনী দুটি। নদীতে কয়েকটি বিলাসবহুল ট্রলার ও কয়েকটি অতিমাত্রায় গতিশীল ছোট ট্রলারের মাধ্যমে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তারা।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের উপজেলা ভেড়ামারার এক বালু ব্যবসায়ী জানান, মাস দেড়েক আগে বালুবাহী ট্রলার নিয়ে চাঁদাবাজদের কবলে পড়তে হয় তাকে। সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে থানায় অভিযোগ না করলেও বিট পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দৌলতপুরের চরাঞ্চলের চাঁদাবাজদের কার্যকলাপে দৌলতপুর, ভেড়ামারা এবং বাঘার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। চাঁদা না দিলে মালভর্তি কার্গো অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করা হয়। শ্রমিকদের গালাগাল দেয়া ও মারধর করা হয়।

একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বলেন, জলদস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারো নেই। আমরাও মুখ খুলে বিপদে পড়তে চাই না। এ সময় সাংবাদিকদের ছদ্মবেশ ধারণ করে পদ্মায় যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি জানান, নদীতে গেলেই চাঁদাবাজদের অস্ত্রের মহড়া ও চাঁদাবাজি সহজেই দেখা যাবে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক ইউপি মেম্বার বলেন, বালুবাহী কার্গো প্রতি ১ হাজার থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিয়ে চলতে হয়। মাসে একেকজন ব্যবসায়ীকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের চাঁদার টাকা গুনতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দৌলতপুরের এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে গেলে তাকেই উল্টো মিথ্যা মামলা এবং হামলার শিকার হতে হয়। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে মামলা দিয়েছে এবং বিভিন্ন রকমের গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করে রেখেছে, যেন তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিষয়টি আলোচনায় না আসে।

স্থানীয়রা জানান, বাহিনী প্রধান উজ্জল সর্দার এক সময় ছাত্রদলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চর এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তার। চরাঞ্চলের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান লালচাঁদ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর উজ্জল বাহিনীর আবির্ভাব ঘটে। পরে ২০০৭ সালে বিদেশ চলে যান উজ্জল। দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় প্রবাস জীবন কাটিয়ে ২০১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরপর থেকে আবারো সেই পুরনো রূপে ফেরেন, নিজ নামে বাহিনী গড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন উজ্জল সর্দার। তবে গণমাধ্যমে বের হওয়া খবরের প্রেক্ষিতে পুলিশের তৎপরতার কারণে সম্প্রতি তিনি নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছেন।

পদ্মায় সক্রিয় থাকা আরেক বাহিনী প্রধান সাঈদ তিন মাস কারাগারে থেকে মাসখানিক আগে বের হয়ে এসে ফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। বর্তমানে এই দুই বাহিনীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। রয়েছে একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে। তারা আলাদাভাবে চরাঞ্চলে সক্রিয় থাকলেও উভয়ের মধ্যে অশান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যে কোনো মুহূর্তে তারা নিজেরাই একে অপরের সঙ্গে খুনোখুনিতে লিপ্ত হতে পারেন বলে এলাকার সাধারণ মানুষজনের আশঙ্কা।

সস্প্রতি দৌলতপুর থানায় উজ্জল সর্দারের নামে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নদী থেকে জোর করে নৌকা কেড়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়। পদ্মায় মাছ শিকার করতে যাওয়া ভুক্তভোগী জেলে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ফতিপুর গ্রামের রফেজ মণ্ডলের ছেলে ইলিয়াস মণ্ডল অভিযোগে উল্লেখ করেন, গত ৩ আগস্ট তারা ঘাটে নৌকা রেখে সকালের খাবার খেতে যান। পরে এসে দেখেন তাদের দুটি নৌকা নেই। উজ্জল বাহিনীর সদস্য বিল্লাল, নয়ন ও বক্করসহ ১০ থেকে ১২ জন এসে নৌকা দুটি নিয়ে যান বলে তিনি অভিযোগ করেন।

আরো পড়ুন:
১ বছর ৯ মাসের ছাড় পেলেন সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা
বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে স্বামী-স্ত্রী আহত

দৌলতপুর সীমান্তের শেষে ও রাজশাহী সীমান্তের শুরুতে পদ্মা নদী থেকে যেসব বালু তোলা হয় মূলত সেই বালুবাহী কার্গো থেকে চাঁদা উত্তোলনের জন্য নদীতে এই দুই সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। ১৫ আগস্ট বাঘায় অস্ত্রসহ আটক হওয়া তিন যুবক সাঈদ বাহিনীর অন্যতম সদস্য। এদের মধ্যে মিঠুন ও মোমিন সাঈদের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেন বলে জানা যায়। সাঈদের ভাই হিসেবেও এলাকায় মোমিনের পরিচিতি রয়েছে।

সশস্ত্র দুই সন্ত্রাসী বাহিনীর হিংস্রতায় ভীতসন্ত্রস্ত এলাকাবাসী বলেন, চরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে অন্ধকার জগতের এই দুই বাহিনী এমন কোনো কাজ নেই যা করতে পারে না। এ কারণেই তারা এসব বিষয় নিয়ে চুপ থাকেন। ফলে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিঘ্নে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। নদীর ভরা মৌসুম এবং তীব্র স্রোত ব্যবহার করে বিভিন্ন পয়েন্টে তারা এসব কাজ করেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, চরাঞ্চলের দুটি জলদস্যু বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ভুক্তভোগীদের কেউ অভিযোগ করেননি। বিচ্ছন্নভাবে কিছু চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পদ্মা থেকে দুটি নৌকা নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দুই বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা না ঘটে সেই ব্যাপারে পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বলে ওসি জানিয়েছেন।

আগস্ট ১৯.২০২১ at ২০:৫০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ জআ