কালীগঞ্জের অগ্রনী ব্যাংকে ঋন জালিয়াতিতে তুলকালাম

প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিসহ কৃষকদের কাগজপত্র জাল করে লক্ষ লক্ষ টাকা আতœসাৎ ২ কর্মকর্তা সাময়িক বহিষ্কার, ১ জনকে অব্যাহতি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের থানায় জিডি

প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিসহ অসংখ্য কৃষকের নামে জাল কাগজপত্র তৈরী করে লাখ লাখ টাকার কৃষি ঋণ তুলে আত্বসাৎ করেছে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের অগ্রণী ব্যাংকের ২ কর্মকর্তাসহ এক মাঠসহকারী। সম্প্রতি তদন্তে এ ঘটনা প্রমানিত হওয়ায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপক ও ক্রেডিট অফিসার কে সাময়িক বহিস্কার এবং এক মাঠ সহকারীকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপককে জীবননাশের হুমকি দেয়ার প্রেক্ষিতে থানায় জিডি করেছেন।

প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিসহ অসংখ্য কৃষকের নামে জাল কাগজপত্র তৈরী করে লাখ লাখ টাকার কৃষি ঋণ তুলে আত্বসাৎ করেছে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের অগ্রণী ব্যাংকের ২ কর্মকর্তাসহ এক মাঠসহকারী। সম্প্রতি তদন্তে এ ঘটনা প্রমানিত হওয়ায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপক ও ক্রেডিট অফিসার কে সাময়িক বহিস্কার এবং এক মাঠ সহকারীকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপককে জীবননাশের হুমকি দেয়ার প্রেক্ষিতে থানায় জিডি করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাখা ব্যবস্থাপক নাজমুস সাদাত। কৃষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গরমিল হওয়া টাকার পরিমান এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তার পরিমান ৫০ লক্ষাধিক টাকার মত বলে শাখা ব্যবস্থাপক স্বীকার করলেও প্রকৃত পক্ষে কত টাকা আত্বসাৎ করা হয়েছে এবং তা কতজন গ্রাহকের টাকা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখা অফিসসূত্রে জানাগেছে,বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক যোগদানের পর কিছু কৃষি ঋন গ্রহিতারা ঋন নেননি বলে অভিযোগ করেন। এরপর শাখা ব্যবস্থাপক বিষয়টি খতিয়ে দেখে অসংখ্য অসঙ্গতি পেয়ে জোনাল অফিসকে জানান।
আরও পড়ুন:
জীবননগরে ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবস পালিত
ঝিনাইদহে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন
ফ্রান্স বিশ্বনবীর ব্যঙ্গ করে মুসলমানদের কলিজা আঘাত করছে : মাওলানা আমিনুল ইসলাম

এরপর শুরু হয় তদন্ত। জোনাল অফিসের তদন্তে আরও কিছু অসঙ্গতি বেরিয়ে আসে। সর্বশেষ পিন্সিপাল অফিস ঢাকার তদন্ত টিমও অসঙ্গতির প্রমাণ পেয়ে আর্থিক অনিয়মের কারণে সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন কুমার বিশ^াস, ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালামকে সাময়িক বহিস্কার ও মাঠ সহকারী (অস্থায়ী) আজির আলীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে পূর্বের শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন কুমার বিশ^াস চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক অফিসে, ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম কালীগঞ্জ শাখায় ও মাঠ সহকারী আজির আলী ঝিনাইদহ হামদাহ শাখায় সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন।
ব্যাংকসূত্রে আরও জানাগেছে,কৃষি ঋনগুলোতে ব্যাংকের মাঠকর্মি কৃষক যাচাই বাছাই করেন। ঋনের জন্য সুপারিশ করেন ক্রেডিট কর্মকর্তা,সর্বশেষ শাখা ব্যবস্থাপক আরেক তরফা কাগজপত্র দেখে মঞ্জুরী দেন বা ঋনের অনুমোদন দেন। আর গ্রাহক আবেদনসহ স্বাক্ষর করা সকল কাগজপত্র জমা দেন। গ্রাহকের সনাক্তকারী হিসেবে একজন স্বাক্ষর দেন। ব্যাংকসূত্রে আরও জানাগেছে, কয়েক বছর আগে কৃষি ঋন নিয়েছেন অথচ পরিশোধ হয়ে গেছে। তাদের পুরাতন কাগজপত্র বিশেষ পদ্ধতিতে নতুনভাবে তৈরী করে ঋণ পাশ করে আত্বসাৎ করা হয়েছে। এখন গ্রাহকেরা জানতে পারছেন তাদের নামে ব্যাংকে ঋণ আছে। আবার অনেকের ঋন নেয়া আছে। তাদের ফাইলের কাগজপত্রও একইভাবে কাজে লাগিয়ে ঋন বাড়িয়ে উদ্বৃত্ত টাকা আত্বসাৎ করেছে এই অসাধু চক্র। অথচ গ্রাহকেরা এটা জানেনই না। এমন অবস্থার মধ্যে অনেক আগেই মারা গেছেন এমন মৃত মানুষের নামও রয়েছে। অনেক আগে ঋন নিয়ে পরিশোধ করে বিদেশ চলে গেছেন এ চক্রের হাত থেকে এমন প্রবাসীরাও রেহায় পাননি।
যা কালীগঞ্জে এখন মুখোরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে।
এ ব্যাংকের খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেক আগে কৃষি ঋন নিয়ে পরিশোধ করেছেন এমন সাবেক গ্রহিতারাও চরম দুঃচিন্তায় পড়ে ব্যাংকে তাদের ঋন ফাইল দেখতে ভীড় করছেন। তবে সুযোগ সন্ধ্যানী অনেক ঋন গ্রহীতাও ঋন নিয়েও অস্বীকার করার পায়তারা করছেন বলে ব্যাংক মনে করছেন।
জানাজানির পর মাঠকর্মি আজির আলী তোপের মুখে এলাকার কয়েকজন কৃষকের টাকা গোপনে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে বিশ্বস্তসূত্রে জানাগেছে।

ব্যাংকটির অনিয়মের বিষয়ে খোজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৩ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের আব্দুল মালেক। তার নামেও কৃষি ঋন তোলা হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। পুকুরিয়া গ্রামের হোসেন আলী মারা যাবার ২ বছর পরও ৪৭ হাজার টাকা ঋন তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মনোহরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম জানান, বেশ কয়দিন আগে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৩/৪ জন লোক এসে বললেন তার স্বামী নাকি ৬ মাস আগে ব্যাংক থেকে ৪৮ হাজার টাকা ঋন নিয়েছেন। কিন্ত তার স্বামী তো ৩ বছর আগে মারা গেছেন। মৃত্যুবরনের পরে কিভাবে তিনি ঋণ নিলেন এটা নিয়ে এলাকায় হাসি তামাশার সৃষ্টি হয়েছে।
ছোট সিমলা গ্রামের কৃষক গোলাম রসুল জানান, তিনি এ ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার টাকা কৃষি ঋন নিয়ে পরিশোধ করেছেন। নতুন কোন ঋন নেননি। তার বাবা ওলি মালিথার নামে ২০ হাজার টাকার ঋন নেয়া ছিল। ৩ মাস আগে তিনি মারা গেছেন। পরে জানতে পেরেছেন ব্যাংকের মাঠকর্মি আজির আলী কাউকে কিছু না জানিয়ে রিনু করে টাকা বাড়িয়ে আত্বসাৎ করেছেন। পরে আজির আলীকে বলার পর উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে দিতে চেয়েছে। এদিকে সোমবার ব্যাংকে নিজে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলেছেন তার নিজের নামে ৪৫ হাজার আর বাবার নামে ৫০ হাজার টাকার ঋন রয়েছে। এমন ঘটনা তার এলাকায় অনেক আছে।
ওই গ্রামের আরেক কৃষক ফুরহাদ আলী জানান, বেশ কিছুদিন আগে একটা কৃষি ঋনের জন্য পরিচিত মুখ ব্যাংকের আজির আলীর কাছে কাগজপত্র জমা দিয়ে প্রায় ৩ মাস ঘুরেছেন। কিন্ত তাকে ঋন দেয়া হয়নি। এখন চারদিকে যে খবর গত ১ বছর আগে ঝর্ণা মারা গেছে। এখন শুনছেন তাদের নামে ব্যাংকে লোন পাশ হয়েছে।
কালীগঞ্জ পৌর এলাকার আড়পাড়া গ্রামের বাসিন্দা কনিকা অধিকারী জানান, বেশ আগে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো শোধ করতে পারেননি। কিন্তু এরই মাঝে ব্যাংক থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে নতুন ৫৫ হাজার টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। অথচ তিনি নতুন কোন ঋণ নেননি। তিনি আরও বলেন, শুধু তিনিই না তার মহল্লার অনেকের নামেই এ ব্যাংক থেকে ঋন নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। অথচ তারা জানেনই না। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এভাবেই অনেক ব্যক্তির কাগজপত্র জাল করে টাকা তুলে নিয়েছেন ব্যাংকের একটি অসাধু চক্র।
আড়পাড়া গ্রামের অচিন্ত বিশ্বাস জানান,আমার একটা কৃষি ঋন নেওয়াছিল। আমি যখন একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলাম। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিলেন আমার ঋনটা রিন্যু করে বাড়ানো হয়েছে। আমি জানলাম না অথচ ব্যাংকের মত স্থানে এমন কাজ হচ্ছে এটাতে আমি হতবাক হয়েছি।
নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কমল দাস জানান, ব্যাংক থেকে ৯ হাজার টাকা ঋন নেয়া ছিল। এখন শুনছি ৩৫ হাজার টাকা ঋন আছে। এতো টাকা কিভাবে হলো তার সঠিক জবাব দিতে পারেননি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
পুকুরিয়া গ্রামের গৃহবধু রেশমা খাতুন জানান, অগ্রনী ব্যাংকের একটি কৃষি ঋন ৮/৯ বছর আগে পরিশোধ করে তার শশুর আলী আহম্মদ আর ঋন তোলেননি। কিন্ত চলতি বছরের মার্চ মাসে তার নামে আবার ৬০ হাজার টাকার লোন ব্যাংকের আজির আলী গং তুলে নিয়েছে শুনে তারা ব্যাংকে গিয়ে সত্যতা পেয়েছেন। এরপর আজির আলী টাকা দিয়ে দিবেন বলে বার বার সময় নিচ্ছে। কিন্ত দিচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ওই গ্রামের ইয়ার আলীর ৫০ হাজার টাকা ঋন তোলা ছিল। ব্যাংকের লোকজন তাকে না জানিয়েই শুনেছি ১ লাখ টাকা লোন তুলে নিয়ে নিয়েছে। পরে আজির আলীকে চাপ দেয়ায় সে টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে শুনেছি।
শুধু এরাই নয়, ছোট সিমলা গ্রামের কৃষক নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস, মনোহরপুর গ্রামের আব্দুস ছাত্তার, বিল্লাল হোসেন, ডলি বেগম, তিল্লা গ্রামের কবির আলী, একই গ্রামের হাফিজুর রহমানসহ উপজেলার অসংখ্য কৃষকের নামে অসঙ্গতিপূর্ণ ঋন দেয়া হয়েছে ব্যাংকসূত্রে জানাগেছে।
উল্লেখ্য, অগ্রনী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় গত ২০১৭ সাল থেকে কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম করার অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী একাধিক গ্রাহককে প্রতারিত করার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর গত ১ মাস ধরে অগ্রণী ব্যাংকের ঝিনাইদহ আঞ্চলিক অফিসের একটি তদন্ত টিম এ ব্যাংকটিতে তদন্ত চালাচ্ছেন। তদন্তে তারা একাধিক কৃষকের পূর্বের ঋণের কাগজপত্র জাল ও মৃত ব্যক্তিদের ঋনের টাকা বিতরনে অনিয়ম করেছে বলে প্রমান পায়। এরই প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ২ দফা তদন্ত শেষে বর্তমান পিন্সিপাল অফিসের তদন্ত চলছে।
সাময়িক বহিস্কৃত ব্যাংকটির পূর্বের শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন কুমার বিশ^াস বলেন, মাঠ সহকারী আজির আলী ও ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম এ ঘটনায় জড়িত। আজির আলী সব ঋণের সুপারিশকারী। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। মৃত ব্যক্তিদের নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে তিনি তেমন কিছু জানেন না। শুনেছি এখনো তদন্ত চলছে।
বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক নাজমুস সাদাত জানান, যোগদানের পর থেকে অনেক ঋনের অনিয়ম দেখছেন। অনেক কৃষক ঋন নেননি বলে ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যা প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়ায় সাবেক ব্যবস্থাপকসহ ৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তবে কি পরিমান টাকা এবং কতজন গ্রাহকের টাকা এই চক্র আত্বসাৎ করেছে তদন্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত সঠিকভাবে বলা কঠিন। কৃষকদের অভিযোগ দেয়া অসঙ্গতিপূর্ণ ঋনের পরিমান ৫০ লক্ষের উপরে হবে। শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আমার জীবন নাশের হুমকি দিচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে আমি থানায় জিডি করেছেন।

০৭ নভেম্বর, ২০২০ at ১৭:০৭:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এমএস/আরএইচ