বুয়েটের হত্যাকাণ্ড লাইম লাইটে, ক্যাসিনো সম্রাট সাইড লাইনে

এস আর সেলিম
কয়েক মাস আগে বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড সারা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। প্রকাশ্যে রিফাত হত্যাকে ঘিরে অনেক জল ঘোলা হলেও তা থেমে গেছে। তবে এখন রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি মাঝে মাঝে সামনে আসলেও তা টুকটাক ছাড়া খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আর নয়ন বন্ড, সুনাম দেবনাথ, শম্ভু বাবুরা তো আগেই আলোচনার বাইরে চলে গেছেন। এরপর মাঝখানে আলোচিত ঘটনা হিসাবে ছেলেধরা গুজব, মাথা কাটা ও ডেঙ্গু ডিঙিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র বাড়াতে আরো কয়েকটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।

সম্প্রতি হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে ছাত্রলীগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর্থিক দুর্নীতির দায়ে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সস্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ওই সাংগঠনিক পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এ নিয়ে দেশ জুড়ে নানান কথার খই ফুটতে থাকে। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই মোড় ঘুরে যায় যুবলীগের দিকে।

সামনে চলে আসে যুবলীগ আর ক্যাসিনো। গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রভাবশালী ক্যাসিনো ব্যবসায়ী, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ঢাকার গুলশান-২ এর নিজ বাসা থেকে আটক করে র‌্যাব। উদ্ধার করা হয় দুটি অবৈধ অস্ত্র, কয়েক রাউন্ড গুলি ও ইয়াবা। এর আগে তার পরিচালিত ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে নগদ ২০ লাখ টাকাসহ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেন র‌্যাব সদস্যরা।

আরও পড়ুন :
কোটচাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধা অফিসে ককটেল বিস্ফোরণ: বিএনপির ৩ প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলন
শতাধিক বাউকুলের গাছ কেটে দিল দুর্বৃত্তরা: থানায় জিডি

এ ঘটনার পর চরম ক্ষুব্ধ হয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী হম্বিতম্বি করেন। তিনি পুলিশের কড়া সমালোচনা করে রাজধানীর সব থানার ওসিদেরও গ্রেপ্তার দাবি করেন । কিন্তু পরেরদিনে আবার সুর বদলে ফেলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। নমনীয় বক্তব্য দেন। বলেন, যুবলীগের কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হবে। তার এই বক্তব্যটির মানে অনেকটা অপরিষ্কার মনে হয়েছে। গ্রেপ্তার হলে বহিষ্কার আর না হলে, দুস্কর্ম করলেও দলে থাকা যাবে, ব্যাপারটি কী তাহলে এ রকম? যাই হোক প্রথমদিনের ওই অভিযানের পর গণমাধ্যমকে র‌্যাব জানিয়ে দেয়, অপরাধী যে দলেরই হোক, যত প্রভাবশালী হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এই কয়দিনে তাদের কথা কাজে মোটামুটি মিলও দেখা যায়।

এর একদিন পরেই ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনের অফিস থেকে ছয় দেহরক্ষীসহ প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা মাফিয়া ডন জি কে শামীমকে আটক করা হয়। র‌্যাবের ওই অভিযানে উদ্ধার করা হয় নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার ব্যাংক চেক ও বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ। অবৈধভাবে উপার্জন করা অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক জি কে শামীম র‌্যাবের আটক এড়াতে ১০ কোটি টাকা অফার করেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ পেতে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও খবর প্রকাশ হয়েছে। মাফিয়া ডন জি কে শামীম আটক হওয়ার পর তাকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন স্টোরি প্রকাশ-প্রচারে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল গণমাধ্যমগুলো। রাজনীতিক ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শতাধিক সাংবাদিককেও তিনি মাসোহারা দিতেন বলে জানানো হয়েছে। আরো বহু অন্যায় অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে জিকে শামীমের বিরুদ্ধে। যা এখনকার প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়।

সবশেষ গত ৬ অক্টোবর এ পর্যন্ত সর্বাধিক আলোচিত ক্যাসিনো সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটকে আটক করে র‌্যাব। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে যুবলীগের আরেক নেতা এনামুল হক আরমানকেও এই ক্যাসিনো সম্রাটের সাথে আটক করা হয়। যুবলীগ নেতা সম্রাটকে নিয়েও খবর তৈরিতে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে রীতিমতো পাল্লাপাল্লি লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গত কয়েকদিনের অভিযানে আটক হন- কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও বিসিবি সদস্য লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপম ভুঁইয়া এবং অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধান। অন্যদিকে ঢাকার বাইরেও কয়েকটি জেলা থেকে নানা অভিযোগে বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে আটক করা হয়।

এসব অভিযানে প্রায় সবার কাছে থেকেই বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অবৈধ অস্ত্র, স্বর্ণ ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কাছ থেকে কী পাওয়া গেছে তা এখনো জানা যায়নি।

ওপরের কথাগুলোর সারাংশ হচ্ছে- ক্যাসিনো সম্রাটসহ যুবলীগের ঢাকা কেন্দ্রীক তৃতীয় সারির কয়েক নেতাকে আটক ও একের পর এক তাদের অবৈধ অর্থ সম্পদের পাহাড় আবিষ্কার হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ক্লাবে হানা দিয়ে বড়লোকের জুয়ার আসর ক্যাসিনো থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ উদ্ধার করে। এ ছাড়া কয়েকজন যুবলীগ নেতার অফিস-বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা ও প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করে তারা। এ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। সবখানে যুবলীগ আর ক্যাসিনো আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। অনেকে আবার যুবলীগের নামই পাল্টে ‘ক্যাসিনো লীগ’ বলতে থাকেন। তিনদিন আগে যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট আটক হন। সম্রাটকে নিয়ে নতুন করে গণমাধ্যমে তোড়জোড় শুরু হয়। গণমাধ্যমের টপ নিউজে আসার সাথে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনায় উঠে আসেন বহুল আলোচিত যুবলীগ নেতা সম্রাট।

সংবাদমাধ্যমে সেই খবর আর মানুষের মাঝে আলোচনা জমে উঠতে না উঠতেই এবার অত্যন্ত দুঃখজনক আরেকটি টপিক সামনে চলে এলো। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ৬ অক্টোবর আটকের রাতেই বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় যুবলীগ আর ক্যাসিনো ঝড় আপতত থেমে গেছে। লাইম লাইটে চলে এসেছে বুয়েটের হত্যাকাণ্ড। সাইড লাইনে রয়েছেন ক্যাসিনো সম্রাট।

দেশ দর্পণে আরও পড়ুন :
উল্লাপাড়া মেয়রের বিরুদ্ধে অর্থআত্মসাত ও রেকর্ডপত্র চেয়ে দুদকের নোটিশ
পারিবারিক কলহের জেরে গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ

দিন রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝ থেকে সেখানকার মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই হলটির ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ক্রিকেটের উইকেট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন। যা ভাইরাল হওয়া সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করে আটক করেছে পুলিশ। কুষ্টিয়ার সন্তান নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

আবরার ফাহাদের নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি গত দুদিন ধরে গণমাধ্যমে টপ নিউজে পরিণত হয়েছে। পিছিয়ে নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। এ হত্যার ঘটনায় ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। খুনিদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন উত্তাল। হয়ে উঠেছে প্রতিবাদমুখর। অাবরারের নিজ এলাকা কুষ্টিয়ায় বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। সারা দেশেই মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। নৃসংশ এ ঘটনাটিই এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি।

পাঠক কিংবা দর্শক ছাড়া গণমাধ্যম মূল্যহীন। একেক পাঠকের তথ্য চাহিদা একেক রকমের। মানুষের চাহিদার ওপর নির্ভর করে মূলত গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করা হয়। যেই খবরের চাহিদা যত বাড়ে সরবরাহের দিকটাতেও তেমন নজর রাখতে হয়। মানুষের তথ্য ক্ষুধা মেটানো গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তবে কোনো কোনো গণমাধ্যম আবার জোর করে পাঠকদের খবর গেলানোর চেষ্টা করে থাকে। ছোট কোনো ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা।

খবরের কাগজে বড় জোর ডাবল কলামে ছাপার যোগ্য খবরকে আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে লিড আকারে প্রকাশের মাধ্যমে পাঠক আকৃষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়, এটাও ভিন্ন প্রসঙ্গ। এই মুহ্রুর্তে আবরার হত্যাকাণ্ডের আদ্যপান্ত জানার ব্যাপারে পাঠকদের ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। সেই অনুযায়ী গুরুত্বসহকারে মিডিয়াকর্মীরা তা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। তবে দুয়েকদিনের মধ্যে পাঠকের এ আকাঙ্ক্ষা অনেকাংশে কমে আসবে। বুয়েটকাণ্ড তখন তলে পড়ে যাবে। আবার নতুন কোনো ঘটনা এসে ওপরের জায়গা দখল করে নেবে। এভাবেই চলছে। এভাবেই চলবে। তবে ক্যাসিনো সম্রাট কাহিনী মোটেও গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি। এর রেশ থাকবে আরো বেশ কিছুদিন।

বাংলাদেশের সেরা শিক্ষার্থীদের অন্যতম যারা তারাই মূলত বুয়েটে পড়ালেখা করে থাকেন। সেখান থেকে বেরিয়ে দেশের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। বিশেষ করে প্রশাসনেও বুয়েট শিক্ষার্থীদের আধিক্য রয়েছে। আবরার ফাহাদের চিহ্নিত খুনিরাও সেরা ছাত্রদের অন্যতম। কিন্তু এই খুনিরা যদি প্রশাসনে চাকরিতে প্রবেশ করেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তাদের দ্বারা দেশের কোন উপকারটা হবে?। দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দেয়া ছাড়া তারা দেশ ও মানুষের জন্য ভাল কিছু করবে, এটা এখন আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। যদিও একটি ঘটনাকে দিয়ে ঢালাওভাবে সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ণ হয় না। তবুও দিনকে দিন পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা সম্ভবত সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছি!

আমরা আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে এই দেশে নিরাপদে বেঁচে থাকার পরিবেশ চাই। এভাবে প্রাণ হারাতে চাই না। আর কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি হোক, স্বপ্ন ভঙ্গ হোক এটা দেখতে চাই না।

লেখক :
এস আর সেলিম, ভোরের কাগজ প্রতিনিধি

অক্টোবর ০৯, ২০১৯ at ১৭:২২:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/এসআরএস/আজা