ইতিহাস বদলে দেয়া ভাষণ

ছবি- সংগৃহীত।

একটি ভাষণ বদলে দিয়েছিল একটি জাতির ইতিহাস। মুক্তিকামী বাঙালিকে এনে দিয়েছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। সেই ভাষণ নিয়ে প্রায় পাঁচ দশক ধরে গবেষণা চলছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যের শুরুতে কীভাবে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার জানিয়েছিলেন তার বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু।

এরপর বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রয়োজনীয়তা, রক্তে রঞ্জিত রাজপথের ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালির বঞ্চনা, পুরো জাতির দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর নিজের কাঁধে তুলে নেয়া, ভুট্টোর হুমকি উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্যদের পূর্ব বাংলায় এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা ঘোষণা, ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, দেশপ্রেম আর জনগণের প্রতি আস্থা, ১ মার্চ থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ আত্মমর্যাদা এবং অধিকারের দাবির ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রতিটি ঘরকে কেন দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে? তার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনায় কী নির্দেশনা? সবই ছিল ওই ভাষণে। বাঙালি-অবাঙালি আর সব ধর্ম-বর্ণের ৭ কোটি মানুষের ঐক্যের শক্তি, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আত্মত্যাগের অঙ্গীকার এবং প্রথমে বাঙালির মুক্তি এবং পরে স্বাধীনতার যে বাক্যগুলো তিনি বলেছিলেন তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’

একাত্তরের ৭ মার্চ। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাবা-মা, স্ত্রী, পাঁচ সন্তান নিয়ে এক সাধারণ জীবনযাপন করছিলেন এই মহান নেতা। তাঁর কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বেশ বিচলিত। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ৩ মার্চে নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন ভেঙে দেওয়া, দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলন ও হরতাল, জনগণের প্রত্যাশার চাপ, সব মিলিয়ে জীবনের এক কঠিন দিন পার করছিলেন তিনি।

এরই মধ্যে ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজন করা হয় বিশাল জনসমাবেশ। ওই দিন দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গেলেন একটু বিশ্রামের জন্য। প্রিয়তমা স্ত্রী পাশে বসলেন পানের বাটা নিয়ে। সহজ-সরল এই গৃহবধূ নিজ স্বার্থ আর সন্তানের মায়া ত্যাগ করলেন দেশের মায়ায়। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাউকে ভয় করবে না। দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তোমার যা বলা উচিত তাই বলবে, নিঃসঙ্কোচে বলবে, নির্ভয়ে বলবে। সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করল প্রিয়তমা স্ত্রীর এই অনুপ্রেরণা। বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দান তখন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান। মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনায়- স্লোগান মুখরিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সামনে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘মাইকটা দে’। তারপর শুরু করলেন তাঁর কিংবদন্তিতুল্য ভাষণ। প্রথমে তুলে ধরলেন তাঁর দুঃখভরা হৃদয়ের কথা।

কারণ দেশে বিভিন্ন শহরের রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত আর আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত স্বাধীনতা, বেঁচে থাকা আর অধিকার আদায়ের কান্না। একে একে বর্ণনা করলেন প্রথম থেকে তাঁর নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তাব, যাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। বায়ান্ন থেকে একে একে প্রায় প্রতিটি বছরে যে রক্তপাত ঘটিয়েছে তারা তারও বর্ণনা দিলেন। এই বর্ণনা থেকে বাদ যায়নি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কথাও।

নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, জনগণের অধিকারই তাঁর কাম্য। এই অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক হরতাল ও সর্বগ্রাহী আন্দোলনের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তাঁর অবর্তমানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সবশেষে তাঁর অগ্নিঝরা কণ্ঠে ফুটে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মন্ত্রের মতো কাজ করে তাঁর এই ঘোষণা। অচল হয়ে পড়ে সমগ্র দেশ, শুরু হয় প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ আর ৩০ লাখ জীবন, নারীর সম্ভ্রম, অমূল্য সম্পদ ধ্বংসের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সৈন্যের হাতে শহীদ হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আরো পড়ুন:
> ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ
> আপত্তিকর অবস্থায় ইবি লেকে ইডেনছাত্রী আটক

ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে স্থান দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ১৯ মিনিটের অলিখিত ভাষণটিই প্রয়োজনীয় শব্দে ঠাসা। একটাও অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই। কবিতার ছন্দে অস্ত্রহীন জাতিকে সশস্ত্র যোদ্ধায় পরিণত করলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের প্রতিটি লাইন পৃথক গবেষণার দাবি রাখে।

তাদের মতে, ভাষণের পর ৮ মার্চ থেকে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি কথা বিশ্বের গণমাধ্যম ও বিশ্বনেতারা গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার দুই শত্রু ভুট্টো ও ইয়াহিয়াকে নিয়ে সংযত ভাষায় কথা বলেছেন। তার যে আচরণ তার চেয়ে সংযম তার পরিমিতিবোধ প্রকাশ করেছে তার এই ভাষণে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে কথা হবে।

মার্চ ০৭, ২০২৩ at ০৯:৪৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/বাপ্র/সুরা