দৌলতপুরে ইউএনওর দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সবই লেজেগোবরে

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আবাদি জমির মাটি কেটে এভাবেই ইঞ্জিনচালিত অবৈধ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল জব্বারের দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সবকিছুতেই লেজেগোবরে অবস্থা দেখা দিয়েছে। মাটি কাটা, বালু তোলা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ঠেকাতে গড়িমসি, লোক দেখানো নাটকীয়তা সবই চলছে ইউএনও আব্দুল জব্বারের প্রশাসনিক সময়ে। এসব বিষয়ে ইউএনওর নীরব ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

দৌলতপুর উপজেলার রিফায়েতপুর, ঘোড়ামারা, ঝাউদিয়া, কিশোরীনগর, শিতলাইপাড়া, হাকিমপুর, জগন্নাথপুর, ফিলিপনগর ও গলাকাটিসহ আরো বেশ কিছু এলাকায় চলছে ভূপৃষ্ঠ কেটে খাল খনন। এসব মাটি ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটাসহ নানা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। কখনো দিনভর আবার কখনো বৈদ্যুতিক আলোয় সারারাত ধরে চলছে মাটি কাটার মহোৎসব। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে মাটি উত্তোলন ও বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা রয়েছে। তারপরেও এ উপজেলায় প্রশাসনের নাকের ডগায় এই বেপরোয়া কর্মযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।

এক্সেভেটর (ভেকু) মেশিনে কাটা মাটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ নানা ধরনের গাড়িসহ ভারি ড্রাম ট্রাকে সরবরাহ হওয়ায় সড়কে মাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। সারারাত মাটি কাটা ও মাটির গাড়ি আসা যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী লোকজন উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ইউএনওর কাছে গিয়েও কোনো সুরাহা পাননি বলে জানিয়েছেন। ফলে অবাধে চলছে মাটি কাটার বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, আবাদি জমিতে এসব মাটি কাটা প্রসঙ্গে উপজেলা প্রশাসন অবগত থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আবার লোক দেখানো দুয়েকটি অভিযান চালালে সেখানেও ইউএনওর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে পদ্মায় বালু উত্তোলনও আটকাতে পারছেন না ইউএনও। দিন-রাত সমানে ফসলি জমির মাটি কাটা ও পদ্মার বুক চিঁড়ে বালু তোলা হচ্ছে। এ উপজেলায় যোগদানের শুরুর দিকে ইউএনও আব্দুল জব্বার মোটামুটি কঠোর অবস্থানে থাকলেও পরে অজ্ঞাত কারণে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ইউএনও আব্দুল জব্বারের দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কারণে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আসছে। বিভিন্ন সুবিধা দেয়াসহ উন্নয়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নামে এসব টাকা তোলেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। অনুসন্ধানকালে এসব কথা জানান, পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন চাঁদাদাতা ও ভুক্তভোগীরা। কার্যত ইউএনওর দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সুযোগে এই সিন্ডিকেট মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠেছে। ফলে নানা অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক্সেভেটর মেশিন দিয়ে ইটভাটার জন্য ফসলি জমির মাটি কাটার একটি দৃশ্য।

সূত্র মতে, গত বছরের নভেম্বরে বদলি আদেশ হলেও এখনো দৌলতপুরেই রয়েছেন ইউএনও আব্দুল জব্বার। এই সময়ে দুটি আলাদা অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে উপজেলাব্যাপী ব্যাপক টাকা উত্তোলন করেছেন ওই সিন্ডিকেট সদস্যরা। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে উন্নয়নের নামে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলে আসা অবৈধ ইটের ভাটাগুলো থেকে ইতোমধ্যে ১ লাখ টাকা মূল্যমানের ইট নিয়েছেন ইউএনও। কোনো কোনো জায়গা থেকে নিয়েছেন নগদ টাকাও। যদিও ওই উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে টিআর প্রকল্পের ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে তা একেবারেই অপ্রতুল।

সমাজসেবা দপ্তরের ভাতাভোগীদের ভাতা দেয়ার নামে দুর্নীতির ঘটনাটি দৌলতপুর উপজেলার ব্যাপক আলোচিত একটি ঘটনা। এই দুর্নীতির বিষয়টি গত বছরে তদন্ত শেষ হলেও এর অগ্রগতিতে গড়িমসি রয়েছে ইউএনও আব্দুল জব্বারের।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, সমাজসেবার দুর্নীতি তদন্ত প্রতিবেদনে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আতাউর রহমান দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তবে এই দুর্নীতিতে তার বেশকিছু সহযোগী রয়েছে বলেও আভাস পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় দুর্নীতির ওই তদন্ত প্রতিবেদন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাতে ও পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে ইউএনওর স্থবিরতা প্রসঙ্গেও জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। যদিও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আতাউর রহমান নিজের বিরুদ্ধের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

দৌলতপুর থেকে ইউএনও আব্দুল জব্বারের বিদায় ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পর সীমন্তবর্তী বৃহৎ আয়তনের উপজেলাটিতে মাদক নির্মূলে সচেতনতা সৃষ্টি করার মতো কিছু আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন তিনি। বড় বড় মাদকের ঘাঁটি এড়িয়ে তিনি লালন অনুসারীদের সাধুসঙ্গের আস্তানাকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করায় বিষয়টি অনেকের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। হঠাৎ ইউএনওর এই তৎপরতা কেবলমাত্র নিজের প্রচার-প্রসার বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই বলে মনে করছে এখানকার সুশীলসমাজ। এ ঘটনাকে কেবলই ক্যারিয়ার ভারি করার নাটকীয়তা বলে মন্তব্য করেন সুশীলসমাজের লোকজন।

এদিকে সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টনের ক্ষেত্রেও ইউএনও আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিনিধিরা। সাংবাদিকদের অভিযোগ, ইউএনও জব্বার শুধুমাত্র তার অনুগতদেরই (৩-৪ জন) বারবার ঘুরে ফিরে সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছেন। অন্য সবাইকে এসব বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছেন।

সম্প্রতি সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়েছেন ইউএনও। বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) তিনি গাড়ি নিয়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়ি যান। সেখান থেকে তিনদিন পর শনিবার দৌলতপুরের কর্মস্থলে ফেরেন। সার্বিকভাবে ইউএনও আব্দুল জব্বারের দুর্বল ও অদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এ উপজেলার সবকিছুতেই এখন লেজেগোবরে অবস্থা বিরাজ করছে।

এসব বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এগুলো অস্বীকার করেন।

ফেব্রুয়ারি ২০.২০২৩ at ১৯:৩২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মেইস/এসআর