শপথ নেয়ার পরদিনেই বিতর্কিত চেয়ারম্যান সিরাজের ভাতিজা র‍্যাবের হাতে ইয়াবাসহ আটক

ইয়াবাসহ র‍্যাবের হাতে আটক চেয়ারম্যানের ভাতিজা মাদক ব্যবসায়ী রানা মণ্ডলকে থানায় নেয়া হচ্ছে । ছবি : দেশ দর্পণ।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউপির বিতর্কিত চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল হাইকোর্টের এক আদেশে শপথগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হলেও সেই আইনি বাধা পেরিয়ে শপথ নেয়ার পরদিনেই তার ভাতিজা রাকিবুল ইসলাম রানা মণ্ডল (২৫) ইয়াবাসহ র‍্যাবের হাতে আটক হয়েছেন। উদ্ধার করা হয়েছে ৯০৮ পিস ইয়াবা। এ ঘটনায় উপজেলাজুড়ে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন এই চেয়ারম্যান। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম তাকে শপথবাক্য পাঠ করান।

শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে গোপন সূত্রের খবরের ভিত্তিতে র‍্যাব-১২, সিপিসি-২, পাবনা ইউনিটের সদস্যরা সদ্য শপথ নেয়া রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের ভাতিজা মাদক ব্যবসায়ী রানা মণ্ডলকে আটক করেন। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ওই ইউনিয়নের ভাগজোত ভেটুলতলা এলাকার নিজ বাড়ি থেকে রানা মণ্ডলকে আটক করে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সিরাজ চেয়ারম্যানের আরেক ভাতিজা ময়নাল মণ্ডলের বাড়িতে অভিযান চালান র‍্যাব সদস্যরা। এ সময় ওই বাড়ির একটি কক্ষ তল্লাশি করে ৯০৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার এবং রানা মণ্ডলকে আটক করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় র‍্যাব। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দৌলতপুর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

এদিকে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী রাকিবুল ইসলাম রানা মণ্ডলকে আটকের বিষয়টি প্রত্যক্ষদর্শীরা শুক্রবার দুপুরেই নিশ্চিত করেন। তবে দিনভর খোঁজখবর নেয়া হলেও প্রথমে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। জেলার আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থাই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি। র‍্যাবের কুষ্টিয়া ইউনিট ও জেলা পুলিশের বিভিন্ন শাখায় খোঁজ নেয়া হলে তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে তাদের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ ও রহস্যাবৃত হয়ে ওঠে। রাতে রানা মণ্ডলকে দৌলতপুর থানায় সোপর্দ করা হলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। পাবনার র‍্যাব কর্মকর্তা শফিকুল আলম বাদী হয়ে এ ব্যাপারে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। শনিবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুর ২টার দিকে রানা মণ্ডলকে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের ছত্রছায়ায় সীমান্তে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। তারা সেখানকার বেশ কয়েকটি মাদকস্পট নিয়ন্ত্রণ করছেন। চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের বড় ভাই আলী মণ্ডলের ছেলে ময়নাল মণ্ডল এবং চেয়ারম্যানের মেজো ভাই মৃত আজিল মণ্ডলের দুই ছেলে রানা মণ্ডল ও রিমেল মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটের সঙ্গে মাদকের কারবার চালিয়ে আসছেন। তারা বিভিন্ন কৌশলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক পাচার করে আসছেন। সীমান্তের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী রানা মণ্ডল ঢাকা ও সীমান্ত এলাকার নিজ বাড়ি দুই জায়গাতেই সুবিধামতো অবস্থান করেন। তবে এলাকায় আসলে তিনি বেশিরভাগ সময় চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকেন। সুযোগ মতো তিনি বিভিন্ন মাদক ঢাকায় নিয়ে যান বলেও এলাকাবাসী অভিযোগে জানিয়েছেন।

 দৌলতপুর থানায় নেয়ার পর সীমান্তের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী রানা মণ্ডল। -ছবি দেশ দর্পণ।

একাধিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল মোটরসাইকেলের বিশাল শোডাউন নিয়ে আসেন। আসার পথে পুলিশের উপস্থিতি দেখে বাগুয়ান নামক স্থানে তার মোটরসাইকেলের বহরে অংশ নেয়া একটি মোটরসাইকেল থেকে ফেনসিডিলের ব্যাগ রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু সেটি পুলিশের নজরে পড়ে যায়। এ ঘটনায় ৬৯ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারসহ বাবু ও আসাদুল নামে দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। পরে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল পুলিশকে ম্যানেজ করে তার মাদক সিন্ডিকেটের ওই দুই সদস্যকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন। দৌলতপুর থানার তখনকার ওসি নাসির উদ্দিন উদ্ধার করা সেই ফেনসিডিল পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে ওই দুজনকে ছেড়ে দেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রগুলো জানিয়েছে। পরে সিরাজ মণ্ডল বিষয়টি অস্বীকার করে তার শোডাউনের মোটরসাইকেল থেকে ওই ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। সূত্র মতে, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে যে কোনো শোডাউনে গাড়ির বহর বের হলে সেই সুযোগেও মাদক পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকেন তার সিন্ডিকেটের লোকজন।

চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল সবেমাত্র শপথগ্রহণের পরেই তার ভাতিজা রানা মণ্ডল ইয়াবাসহ র‍্যাবের হাতে আটক হওয়ার ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। আলোচনা-সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না এই ‘গুণধর’ চেয়ারম্যানের। নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়া চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল বৃহস্পতিবার শপথ নেয়ার পরপরই এলাকায় ফের শোডাউন করে নিজের ক্ষমতা জানান দেন। এর পরের দিনেই শুক্রবার চেয়ারম্যানের মাদক ব্যবসায়ী ভাতিজা ইয়াবাসহ আটক হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিরাজ মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এর আগে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিরিষদের নির্বাচনে ফলাফলের বিপক্ষে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদ মনোনীত মশাল প্রতীকের প্রার্থী আজিজুল হক। তার রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক আদেশে নির্বাচন কমিশন থেকে গেজেটভুক্ত হওয়া চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথগ্রহণ স্থগিত করা হয়।

আরো পড়ুন:
সিলেট সিসিকের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের বাসায় হামলা!! বোমা নিক্ষেপ
করোনা মোকাবিলায় এখনো প্রস্তুত নয় রাজশাহী সদর হাসপাতাল

শপথগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়ে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল নির্বাচনে তার বিজয়ী হওয়ার রেজাল্টশিট অনুযায়ী ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেড ডিভিশনে আপিল আবেদন করেন। তিনি হাইকোর্টের দেয়া আদেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করায় আপিল বিভাগ তা আমলে নেন। আপিল বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের অনিয়ম প্রতিকারের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠন করে দেয়া ট্রাইব্যুনালকে শুনানির মাধ্যমে আগামী ১৮০ দিনের (৬ মাস) মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট জেলার সিনিয়র সহকারী জজকে নিয়ে ‘নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল’ এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে ‘নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হয়। ফলে শপথগ্রহণের জন্য তার আইনি বাধা দূর হয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম নিজ কার্যালয়ে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদে গত পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতাসহ ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। নানা অনৈতিক ও খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি পুরো উপজেলাব্যাপী চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েন। নির্বাচনের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের এক সমাবেশে তিনি দলের এই শীর্ষ নেতার ভুল নাম সংবলিত ব্যানার নিয়ে শোডাউন করতে গিয়ে সমালোচনার শিকার হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের মোটরসাইকেল শোডাউনের বহর থেকে ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে জাতীয় ও দলীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন করেও বেশ সমালোচিত হন এই চেয়ারম্যান। সর্বশেষ শপথগ্রহণের পরের দিনেই মাদক ব্যবসায়ী ভাতিজা মাদকসহ আটক হওয়ার ঘটনায় আবারো নতুন করে বেকায়দায় পড়ে যান সিরাজ মণ্ডল। ক্ষমতা প্রদর্শন করে বারবার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া দুইবারের এই চেয়ারম্যানকে অনেকে ‘সীমান্তের গডফাদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

জানুয়ারি ১৫.২০২২ at ১৮:১৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এআস/জআ