দাম ও মান নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন, সেট টপ বক্স নিয়ে স্বেচ্ছাচার

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের গ্রাহকদের সেট টপ বক্স স্থাপনে বাধ্যবাধকতা ছিল। বাকি বিভাগীয় শহরের জন্য সময়সীমা করা হয় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে দাম ও মান নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন, এত কম সময়ে বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে মনে করেন ক্যাবল অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)।

২২ নভেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার বেঞ্চ সরকারি এ সিদ্ধান্ত এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পান ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেট টপ বক্স স্থাপনে এক মাস বাড়তি সময় পাওয়া গেলেও এর দাম ও প্রাপ্যতা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কমেনি গ্রাহকের। হাজার টাকার কমে আমদানি করা সেট টপ বক্স এরই মধ্যে বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সেট টপ বক্স মজুত ও আমদানির পাইপলাইনে না থাকায় নির্ধারিত সময়ে সব গ্রাহকের ঘরে তা পৌঁছানো নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে ক্যাবল টিভি সংযোগের আধুনিকায়নে সরকারের নেয়া এ উদ্যোগটি শুরুতেই বেশ চ্যালেঞ্জে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, এত কম সময়ে আড়াই থেকে ৩ কোটি গ্রাহকের ঘরে সেট টপ বক্স বসানো সম্ভব নয়। বর্তমানে মাত্র ৩ শতাংশ গ্রাহকের সংযোগ ডিজিটাল। বাকি ৯৭ শতাংশ গ্রাহক অ্যানালগ বা প্রচলিত ডিস সংযোগ ব্যবহার করেন।

ক্যাবল অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, সেট টপ বক্সের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ বিষয়ে এখনো পরিকল্পনা করা হয়নি। আমরা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি জানান, ৯৫ শতাংশ সেট টপ বক্স চীন থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে কোনো সেট টপ বক্স প্রস্তুত হয় না। করোনা মহামারির কারণে চীনে এখনো ফ্যাক্টরিগুলো পুরোপুরি চালু হয়নি। কাজেই এত অল্প সময়ে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা: বাজারে নানা ব্র্যান্ড ও মডেলের সেট টপ বক্স কিনতে পাওয়া যায়। বৈশিষ্ট্য ভেদে এগুলোর দাম ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে ডিস ব্যবসায়ীরা যে সেট টপ বক্স গ্রাহকদের দিচ্ছেন সেগুলোর দাম যাচাইয়ের সুযোগ নেই। তারা নিজেরাই গ্রাহককে সেট টপ বক্সের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। আর যে কর্মী গ্রাহকের বাসায় সেটি স্থাপন করছেন, এর মডেল, ব্র্যান্ড বা কনফিগারেশন জানেন না তিনিও। ফলে কত দামের জিনিস কত দামে গ্রাহককে দেয়া হলো এর সদুত্তর পাওয়া যায় না কারো কাছে।

পুরান ঢাকার চকবাজারে ডিসিএন নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সেট টপ বক্স নিয়েছেন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর। এ জন্য তার কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা অমিত হাসান স্থানীয় কসমিক স্যাটেলাইট টিভি নেটওয়ার্কের কাছ থেকে সেট টপ বক্স নিয়েছেন ২ হাজার ২০০ টাকায়। বারিধারার বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা নিয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। কিন্তু কেউ-ই এর আসল দাম জানেন না।

আরো পড়ুন:
যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ জন হতাহত
উন্মুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, সমঝোতা সই আজ

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারসহ বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, হ্যালোবক্স-৬ সেট টপ বক্সের দাম ১ হাজার ৭০০ টাকা, সানডিরেক্ট ৯৫০ টাকা, স্টারেক্স ২ হাজার ৪০০ টাকা, টিএক্স, জিয়ামনি ও বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন মডেলের বক্স ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

গ্রাহক স্বার্থ রক্ষার নির্দেশনা নেই: গ্রাহক কীভাবে সেট টপ বক্স সংগ্রহ করবেন সেটি এখনো স্পষ্ট করেনি সরকার। তবে মাঠ পর্যায়ের ডিস ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রাহক সরাসরি দোকান থেকে সেট টপ বক্স কিনতে পারবেন না। ডিস অপারেটরের কাছ থেকে তা নিতে হবে। এ কারণে গ্রাহক পছন্দ অনুযায়ী কনফিগারেশনের সেট নাও পেতে পারেন। আবার কোনো অপারেটরের সেবা পছন্দ না হলে সংযোগ পরিবর্তন করতে গেলেও বিপত্তি হতে পারে। কারণ, ওই বক্সের কোড ও পাসওয়ার্ড রিসেট করার জন্য আলাদা সার্ভিস চার্জ দাবি করতে পারে নতুন অপারেটর। এমনকি নতুন বক্সও কিনতে বলতে পারেন কেউ। তাই বিষয়গুলো আগে থেকেই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত বলে মনে করেন ব্যবহারকারীরা। যদিও তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এ নিয়ে কাউকে একচেটিয়া ব্যবসা করতে দেয়া হবে না। গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায়ও সব ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে কোয়াব সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, আমরা অনেক ধরনের পরিকল্পনা করছি। কিন্তু এখনো কিছুই চূড়ান্ত করতে পারিনি। তিনি বলেন, এগুলো কোয়াব সদস্যদের কাছ থেকে নিতে হবে, নাকি বাজার থেকেও কেনা যাবে, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কোয়াব সদস্যরা গ্রাহকদের সেট টপ বক্স দিতে গেলে ৩-৪ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এটা মুখের কথা নয়। টাকার অভাবে বাস্তবায়নের গতি কমে যাবে। আবার গ্রাহককে কিনতে বললেও অনেকে গরিমসি করবেন। দুদিকেই সমস্যা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এত সেট টপ বক্স পাওয়া নিয়ে শঙ্কা: দেশে চাহিদার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ সেট টপ বক্স মজুত আছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে দ্রুততম সময়ে দেশে প্রায় আড়াই কোটি নতুন সেট টপ বক্স দরকার হবে। এত বক্স ২/৩ মাসেও চীন থেকে আনা সম্ভব নয়। কারণ, ওই দেশটির অনেক কারখানায় এখনো পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়নি। চীনের অনেক অঞ্চলে দীর্ঘ শীতকালীন ছুটি শুরু হয়েছে। আমদানি ও শিপমেন্টেও সময় প্রয়োজন। তাই এটি বাস্তবায়নে অন্তত দেড় বছর সময় দেয়ার দাবি কোয়াব নেতাদের। অন্যদিকে ফিড অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতারা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সেট টপ বক্স বাস্তবায়ন করতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁধে দেয়া সময় পর্যাপ্ত নয়। অন্তত আরো ৬ মাস প্রয়োজন। তারা বলেন, শুধু সেট টপ বক্স হলেই চলবে না, এটি স্থাপনে প্রশিক্ষিত লোকজনও দরকার, যা নেই বর্তমান ব্যবসায়ীদের।

কী সুবিধা মিলবে সেট টপে: সেট টপ বক্স চালু হলে দর্শক, সরকার ও ক্যাবল অপারেটর সবারই লাভ হবে। শুধু লোকসান হবে কর ফাঁকি দেয়া ব্যবসায়ী ও কর্মীদের। সেট টপ বক্সের কারণে এলইডি, এলসিডি বা ভালো মানের টিভিতে পুরোপুরি হাই ডেফিনেশন বা ফুল এইচডি ছবি দেখা যাবে। বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন দর্শকরা। এছাড়া এই পদ্ধতিতে পছন্দমতো অনুষ্ঠান ও চ্যানেলের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে দর্শক তার পছন্দের অনুষ্ঠান বা চ্যানেল সহজেই দেখতে পারেন।

অন্যদিকে, সরকারের রাজস্ব আদায় সহজ হবে। বর্তমানে অপারেটররা বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেন। এ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৩৫ শতাংশ করপোরেট কর পাওয়ার কথা সরকারের। সে অনুযায়ী বছরে ২ হাজার কোটি টাকার পাওয়ার কথা থাকলেও অপারেটররা দিচ্ছেন মাত্র ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা।

নেটওয়ার্ক ডিজিটাল হলে অপারেটররাও সুবিধা পাবেন। যারা পাড়া-মহল্লায় সংযোগ দেয়, তারা অনেক সময় সঠিক সংযোগ সংখ্যাটি অপারেটরদের জানায় না। এ কারণে অপারেটররা সঠিক বিল পায় না। সেট টপ বক্স নিলে টাকা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না।

এছাড়া বড় সুবিধা হবে দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্ষেত্রে। টেলিভিশন মালিকদের সমিতি অ্যাটকোর সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল বাবু জানান, এটা নিশ্চিত হলে ভবিষ্যতে পে-চ্যানেলের দিকে যাওয়া যাবে। এতে সংকটে থাকা চ্যানেলগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে। ফলে অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে বিনিয়োগ করা যাবে। এটি হবে দেশের জন্য একটি মাইলফলক।

ডিসেম্বর ১৯.২০২১ at ১০:৫৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভক/জআ