বৃদ্ধের আত্মহত্যা ও গণমাধ্যমের খবর

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডি সীমান্ত এলাকায় ইদ্রিস আলী নামে প্রায় ষাট বছর বয়সী এক বৃদ্ধের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক কী কারণে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন এখনো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেউ বলছেন ক্ষুধার যন্ত্রণায়, আবার কেউ বলছেন পারিবারিক কলহে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার না হতেই ‘দৌলতপুরে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বৃদ্ধের আত্মহত্যা’ এমন শিরোনামে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও গরম হয়ে উঠেছে। উঠে আসছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। গত দুইদিন ধরে এই তোলপাড় অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) কয়েকটি জাতীয় গণমাধ্যমে আসা হুবহু একই কিংবা সিন্ডিকেট খবরটির মাঝে এতবড় একটা স্পর্শকাতর খবরের সোর্স হিসাবে শুধুমাত্র স্থানীয়দের বরাত দিয়ে গদবাধা কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধির বক্তব্যও চোখে পড়েনি। প্রকাশ করা হয়েছে মরদেহের বীভৎস ছবি। যা দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলো এড়িয়ে যায়। স্বজনদের আহাজারি কিংবা প্রতীকী ছবি ব্যবহার করে তারা। তবে সবার আগে চোখে পড়া ইনকিলাব খবরের সঙ্গে প্রথমে বীভৎস ছবি প্রকাশ করলেও পরে তারা ছবিটি সরিয়ে দিয়েছে। জনকণ্ঠেও একই খবর এসেছে। খবরটির হেডিং থেকে শুরু করে বডি পর্যন্ত কোথাও কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়নি। হুবহু একই অবস্থা দেখা গেছে সিন্ডিকেটের কব্জায় থাকা অন্যান্য গণমাধ্যমেও।

এছাড়া আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির এনআইডি অনুসারে জন্ম ১৯৬২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে তার বয়স ষাট বছরের কাছাকাছি হলেও নিউজে সম্বোধনের নিয়মটিও মানা হয়নি। অথচ ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ হলেই সম্বোধন আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। খুব সাধারণ কিছু বানানেও ভুল রয়েছে। যা সম্ভবত নিউজ মেকারের অজ্ঞতার কারণেই হয়েছে। কিন্তু ওই গণমাধ্যমগুলোর নিউজ এডিটিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা হুবহু কেন প্রকাশ করেছেন তা কিছুতেই মাথায় আসছে না। যদিও এ বিষয়ে তারাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে হত্যা অথবা আত্মহত্যা যেটাই হোক সেই ঘটনায় আসা খবরের প্রথম ধাপেই হত্যা, আত্মহত্যার মূল কারণ নিশ্চিত না হয়ে প্রকাশ করাটা কতটুকু যৌক্তিক? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

যেহেতু বৃদ্ধ ইদ্রিস আলীর আত্মহত্যার ঘটনায় সুইসাইড নোট কিংবা চিরকুট পাওয়া যায়নি। সুতরাং আগেই নিউজে ক্ষুধার রঙ লাগানো ঠিক হয়নি। এটা সাংবাদিকতার রীতিনীতির মধ্যেও পড়ে না। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানের পর ফলোঅাপ রিপোর্টেও তো ঘটনার কারণ উল্লেখ করার সুযোগ রয়েছে। কী ঘটেছে সেটা দিয়ে প্রথমে নিউজটি কভার করার পর প্রয়োজনে সময় নিয়ে ফলোআপ রিপোর্টে কেন ঘটেছে বিস্তারিত দেয়া যেত। এভাবে তাড়াহুড়ো করে প্রথমেই একটি স্পর্শকাতর তথ্যের সংযোগ ঘটিয়ে এলাকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দরকার ছিল না। এটা কী তাহলে উদ্দেশ্যমূলক প্রয়াস ছিল। হতে পারে এলাকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বিতর্কের মুখে ফেলতে নতুবা ভালো কভারেজ পেতে। উদ্দেশ্য যেটাই হোক এ বিষয়ে পুরোপুরি অপেশাদার মানসিকতার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে এটা নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়। আবার এমনও হতে পারে, খবরটি প্রকাশের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা অনুধাবন করতে না পেরে, না বুঝেই ওই অজ্ঞ, অদক্ষ নিউজ মেকার সেটা ছেড়ে দিয়েছেন।

আরেকবার দেখে নেই আলোচিত খবরটির মাঝে যা উল্লেখ করা হয়েছে : ‘স্থানীয়রা জানায়, বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী বয়স্ক ভাতা বা সরকারী সবধরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। দিনমজুর এক সন্তান থাকলেও সেও রয়েছে ঢাকায়। ছেলেরও বৌ তাকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দিতে কার্পণ্য করতো। অনাহারে অর্ধাহারে অসহায় বৃদ্ধ ইদ্রিস আলীর দিন কাটতো। সোমবার দিনভর অনাহারে থেকে গভীর রাতে সে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে নিজ ঘরে ডাফের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।’ খবরটির শেষ অংশে পুলিশের বক্তব্যের ক্ষেত্রেও কিছুটা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায়ই তার আত্মহত্যার বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যের সোর্স আসলে পুলিশ নয়, তা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দৌলতপুর থানার ওসি (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম জানান, ইদ্রস আলী নামে এক বৃদ্ধের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।’

এখানে প্রথমের অংশটুকু তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ঠিকই আছে। কিন্তু মাঝখানে বলা হয়েছে, ‘সোমবার দিনভর অনাহারে থেকে গভীর রাতে সে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে নিজ ঘরে ডাফের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।’ ইদ্রিস আলীর আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ এখন পর্যন্ত উদঘাটন করা যায়নি বা রহস্যাবৃত রয়েছে। তাই তার আত্মহত্যার কারণটাকে এই মুহূর্তে বাদ রেখেও খুব সরল দুটি প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলো- তিনি অল্প রাতে, গভীর রাতে নাকি ভোর রাতে গলায় ফাঁস নিয়েছেন এটা স্থানীয়রা কেমন করে নিশ্চিত হয়েছেন?। তারা কেউ তো ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। এছাড়া সোমবার দিনভর তিনি অনাহারে ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে স্থানীয়রা ‘জেনেশুনেও’ একজন অনাহারি বৃদ্ধকে এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি কেন?। এই খবরে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে এক তরফা তথ্য সামনে আনা হলেও প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবেন না স্থানীয় কেউই। এমনকি নিউজ মেকার নিজেও এর সদুত্তর দিতে পারবেন না। গতানুগতিক নিউজে ঘটনার সময় অনুমাননির্ভর হয়েও অনেক ক্ষেত্রে চালিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু কোনো স্পর্শকাতর ঘটনার বেলায় সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব ক্ষেত্রে অনুমাননির্ভর হওয়াটা সঠিক নিয়ম নয়। যদিও সময়ের বিষয়টি টেনে আনলাম বলে কারো কাছে অনেকটা বালখিল্যের মতো মনে হলেও হতে পারে। তবে এটাই বাস্তবতা। এ রকমের আরো অনেক বাস্তবতাকে সঙ্গে করেই আমাদের সুষ্ঠু ধারার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাার চর্চা করা উচিত।

এক্ষেত্রে ওই সিন্ডিকেট নিউজ মেকার উল্লেখ করতে পারতেন, ‘রাতের কোনো এক সময় তিনি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে স্থানীয়দের ধারণা।’ এই ‘ধারণা’ শব্দটাতেই অনেক ঝামেলা চুকিয়ে দেয়া যায়। যাই হোক ইদ্রিস আলীর আত্মহত্যার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত চলছে। পেশাদার সাংবাদিকরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে ঘটনাটি অনুসন্ধান করছেন। এই আত্মহত্যার পেছনের ঘটনা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হলেও ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত নাটকীয় মোড় নিতে পারে। অথবা অন্যদিকে মোড় নেয়ানো হতে পারে, এমন সম্ভাবনাও কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে এটা ঠিক যে, ইদ্রিস আলী একজন হতদরিদ্র মানুষ ছিলেন। ছেলের সংসারেই থাকতেন।

ওই অনলাইন গণমাধ্যমগুলোয় ‘ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধের আত্মহত্যা’ এমন স্পর্শকাতর তথ্য সংবলিত খবর বের হওয়ার পর তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়। এ নিয়ে গত দুইদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও সরগরম হয়ে উঠেছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, ক্ষুধার যন্ত্রণায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আবার কেউ বলছেন, পারিবারিক কলহের জেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে খবরটির কাউন্টার দেয়ার মতো তৎপরতাও লক্ষ্য করা গেছে। পুত্রবধূর গয়না চুরির অপবাদে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলেও প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পরেরদিন বুধবার বাংলা ট্রিবিউনে পুলিশের বরাত দিয়ে বের হওয়া খবরের শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘ক্ষুধার জ্বালায় নয়, পুত্রবধূর সঙ্গে অভিমানে বৃদ্ধের আত্মহত্যা’। ছোট পরিসরের খবরটির ভেতরে পুলিশের বাইরে আর কোনো সোর্স অথবা রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়নি। পুলিশের বক্তব্যনির্ভর এই খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দৌলতপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেল, ‘নাতনিকে পেটানো নিয়ে পুত্রবধূর সঙ্গে ইদ্রিস আলীর মনোমালিন্য হয়। এরপর তিনি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। ইদ্রিস আলী পাইলস রোগে আক্রান্ত ছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষুধার জ্বালায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। আসলে এটি সত্য নয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে। ইদ্রিস আলীর বয়স ভোটার আইডিতে ৬৯ বছরের একটু বেশি। নিয়ম অনুযায়ী বয়স না হাওয়ার কারণে তার ভাতার কার্ড হয়নি।’ অর্থাৎ এখানে পুলিশের বক্তব্য মোতাবেক আগেরদিনের খবরকে কাউন্টার দেয়া হয়েছে। এটা সবার কাছেই মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

নিয়মের বাধায় বয়স্কভাতার কার্ড না হওয়ার বিষয়টি এখানে বাদ রাখছি। দেশে গড় আয়ু খুব সম্ভবত ৭২ বছর ৮ মাস। তবে গণমাধ্যমকে দেয়া পুলিশেরই ভাষ্য অনুযায়ী, ৬৯ প্লাস বয়স হওয়ার পরেও আর কতো বয়স হলে বয়স্কভাতার আওতায় আসা যায় তাও সঠিক জানা নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নাতনিকে পেটানোর কারণে পুত্রবধূর সঙ্গে মনোমালিন্যের পর বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা তো পুলিশের অনেকটা দ্বিমুখী বক্তব্যই মনে হচ্ছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ কেন ইদ্রিস আলীর পুত্রবধূর নামে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা না করে অপমৃত্যু মামলা করলো। এই ঘটনাটি কী আত্মহত্যার প্ররোচনার মধ্যে পড়ে না?। নাকি ক্ষুধার কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন, এই বিষয়টি আড়াল করতে পুলিশ তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে? এ ধরনের প্রশ্নই জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার বৃদ্ধ ইদ্রিস আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুধার জ্বালায় তার বাবা আত্মহত্যা করেননি বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, পারিবারিক কলহের কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে বলেও তার দাবি। যদিও সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে সিদ্দিক আলীর কোনো ধারণা ছিল বলেও মনে হয়নি। ফলে এই সংবাদ সম্মেলন তিনি নিজ থেকে করেছেন নাকি তাকে দিয়ে করানো হয়েছে? এটা আরেক প্রশ্ন। তবে এলাকার ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে ‘হঠকারি’ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে সচেতন এলাকাবাসী তাকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়ে থাকলেও তাতে দোষের কিছু নাই।

অনেকে মনে করছেন, একটি এলাকার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের (ক্ষুধার যন্ত্রণা সম্পর্কিত) তথ্য দিয়ে খবর আসাটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে অার্থ-সামাজিক অবস্থা, প্রতিবেশীদের পারস্পারিক সস্পর্ক এবং সমাজ ব্যবস্থাকে হেয় করে। সুতরাং এই স্পর্শকাতর তথ্যটি পরিবেশনে আরেকটু যত্নবান হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা দরকার ছিল। অন্যদিকে এ ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য এবং সেই মোতাবেক যথাযথ আইনি পদক্ষেপ না নেয়ার কারণটাও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার দরকার রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

❑ লেখক : এস আর সেলিম, সাংবাদিক।

অক্টোবর ১৪.২০২১ at ২২:৫৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরসে/রারি