কাহালুর শফিকুল চাতাল ব্যবসায়ী থেকে দেশসেরা রেনু-পোনা উৎপাদনকারী

বগুড়ার কাহালু উপজেলার লোহাজাল গ্রামের মরহুম বছির উদ্দিন মন্ডলের ছেলে আলহাজ্ব মো. শফিকুল ইসলাম চাতাল ব্যবসায়ী থেকে পর পর তিনবার দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাছের রেনু-পোনা উৎপাদনকারী নির্বাচিত হয়েছেন। তিনবারের শ্রেষ্ঠ গুণগতমানের মাছের রেনু-পোনা উৎপাদনকারী হিসেবে তিনি দুবার পেয়েছেন জাতীয় স্বর্ণপদক ও একবার পেয়েছেন জাতীয় রৌপ্যপদক।

কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা, ধৈর্য, সঠিক পরিকল্পনা, সততা ও বিনয়ী ব্যবহারে প্রায় দু-যুগ ধরে তাঁর সাফল্য ধরে রেখেছেন। করোনার মহামারীতেও তাঁর সাফল্যে বৃন্দমাত্র ছেঁদ পরেনি। ইচ্ছে শক্তি দিয়েই তিনি পৌঁছে গেছেন উন্নতির চরম শিখরে। বর্তমানে তাঁর ধ্যান-জ্ঞানই হলো মাছচাষ, গুণগতমানের মাছের রেনু-পোনা উৎপাদন, মাছচাষের বিকাশ ঘটানো।

আশির দশকে যখন এই অঞ্চলের মানুষ যমুনা নদী থেকে রেনু-পোনা সংগ্রহ করে এখানে মাছচাষ শুরু করেন, তখন তিনি ছিলেন ছাত্র। ছাত্র অবস্থায় তিনি চাতাল দিয়ে ধান-চালের ব্যবসা শুরু করেন। চাতাল ব্যবসার পাশাপাশি তিনি স্বপ্ন দেখেন মাছচাষ করার। ওই সময় কাহালুর সাগাটিয়া গ্রামের বিশু, জাহাঙ্গীর সবেমাত্র শুরু করেন হ্যাচারীতে মাছের রেনু উৎপাদনের কাজ। বিষয়টি তাঁর নজরে আসার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন হ্যাচারী প্রতিষ্ঠা করার। তারপর তিনি ব্রড মাছ সংগ্রহ করে নিজ পুকুরে মজুদ রাখেন।

১৯৯০ সালে তিনি প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যায়ে একটি মিনি হ্যাচারী নির্মাণ করেন। ওই সময় তাঁর অভিজ্ঞতা ও ধারনা ছিলোনা, কোনটি পুরুষ আর কোনটি নারী মাছ। যারফলে নিজ হ্যাচারীতে মাছের রেনু উৎপাদনের শুরুতেই তাঁর প্রায় ৬ লাখ টাকার মত লোকসান হয়। মোটা অংকের টাকা লোকসান হওয়ার পরেও তিনি ধৈর্য না হারিয়ে প্রথমে উপজেলা মৎস্য অফিসে এবং তারপর বগুড়া যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মাছচাষ ও রেনু-পোনা উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৯৮ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুরোদমে রেনু-পোনা উৎপাদন ও মাছচাষ শুরু করার পর তিনি বড় ধরণের লাভের মুখ দেখেন। অল্পদিনের মধ্যেই কঠোর পরিশ্রম ও তাঁর প্রশিক্ষণের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির পথে ধাবিত হন। ২০০২ সালে গুণগতমানের রেনু-পোনা উৎপাদনে তিনি দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে জাতীয় স্বর্ণপদক লাভ করেন। জাতীয় স্বর্ণপদক পাওয়ার পর তিনি তার হ্যাচারী বর্ধিত করণের কাজ শুরু করেন।

ওই সময় নানা প্রতিকুলতায় অনেক হ্যাচারী, নার্সারী মালিক ও মাছচাষি কিছুটা লোকসানের মুখে পড়লেও কঠোর পরিশ্রম, গুণগতমানের রেনু-পোনা উৎপাদন, সততা ও সকলের সাথে ভালো ব্যবহারের জন্য তাকে লোকসানের মুখে পড়তে হয়নি। তাঁর প্রতি বিভিন্ন জেলার মাছচাষি ও ব্যবসায়ীদের অগাধ বিশ্বাস জন্মে। যারফলে তার রেনু-পোনা ও মাছের ব্যবসা অন্যান্য ব্যাবাসয়ীর চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।

২০১৩ সালে তিনি পুণরায় দেশসেরা রেনু-পোনা উৎপাদনকারী নির্বাচিত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে জাতীয় রৌপ্যপদক গ্রহন করেন। এই পদক পাওয়ার পর থেকে তাঁর তিল তিল করে গড়ে তোলা হ্যাচারীটি আরো বর্ধিত করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর স্বপ্নের হ্যাচারীটিকে সৌখিন ও নান্দনিকভাবে গড়ে তুলেছেন। তার হ্যাচারীর সৌন্দর্য দেখলে সবাই মুগ্ধ হয়ে যান। এখানে শুধু হ্যাচারী দেখতেই মানুষ আসেনা। অনেকে আসেন এই গুণী মাছচাষি আলহাজ্ব শফিকুল ইসলামের কাছে মাছচাষ ও রেনু-পোনা উৎপাদনের জন্য ভালো পরামর্শ নিতে।

এদিকে সম্প্রতি তৃতীয় বারের মত তিনি দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রেনু-পোনা উৎপাদনকারী নির্বাচিত হয়ে আবারও জাতীয় স্বর্ণপদক লাভ করবার পর তাকে দেখার জন্য প্রতিদিনই ছুটে আসছেন অসংখ্য মানুষ। ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সমাজ সেবক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাছুদুর রহমান, বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক তাকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন। কাহালু পৌর সদরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাকে দেওয়া হয় গণসংবর্ধনা।

আলহাজ্ব মো. শফিকুল ইসলামের শাহ্সুলতান-শাহ্জালাল নামের এই সৌখিন হ্যাচারীটি বগুড়ার কাহালু উপজেলার বিবিরপুকুর বাজারে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের দক্ষিণ পার্শে অবস্থিত। এক একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এই হ্যাচারীতে ১০৫ টি হাউজে দেশী প্রজাতি মাছের রেনু রাখা হয়। ৭০ টি বোতলে মাছের ডিম ফুটানো হয়। ২০ টি সার্কুলার ট্যাঙ্কে মাছকে বিশ্রামে রাখা হয়। ৩টি ওভার ট্যাঙ্কে পানি রিজার্ভ রাখা হয়। এছাড়াও মাছ বহনের জন্য রয়েছে মিনি ট্রাক। হ্যাচারীর পাশেই ৫ টি পুকুর রয়েছে ব্রæড মাছ রাখার জন্য। এছাড়াও পোনামাছ নার্সিং এর জন্য ১০ টি, ব্রæড মাছের জন্য ১০ ও মাছচাষের জন্য ১০টি তাঁর পুকুর রয়েছে।

দেশী প্রজাতি মাছের রেনু-পোনা উৎপাদনের জন্য তাঁর পুকুরে ৩৫ থেকে ৪০ মে.টন ব্রড মাছ মজুদ থাকে। এছাড়াও বাংলা মাছের রেনু-পোনা উৎপাদনের জন্যেও তিনি বেশ কয়েক মেঃটন ব্রড মাছ মজুদ রাখেন। তাঁর হ্যাচারীতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪০০ কেজি রেনু উৎপাদন করা হয়। সেই হিসেবে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে ৪০০ কেজি রেনুর মুল্য ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে রেনু বিক্রি করে শতকরা ২৫ ভাগ লাভ হিসেবে প্রতি সপ্তাহে তার লাভ হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

এছাড়াও তিনি প্রতি সিজিনে প্রায় ৩ কোটি পোনামাছ ও প্রায় ৪০/৪৫ মে.টন আমীষ জাতীয় মাছ বিক্রি করে থাকেন। পোনামাছ ও আমীষ জাতীয় মাছ বিক্রি করে খরচ বাদে তাঁর শতকরা ২৫ ভাগ লাভ থাকে। তাঁর লাভের বড় একটি অংশ ব্যায় করেন গরীব-দুঃখী মানুষ, শিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে। কোন রাজনীতি না করলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তিনি অনেক বেশী টাকা ব্যায় করেন মানুষের কল্যাণকর কাজে। যারফলে দলমত নির্বিশেষে সকল বর্ণের মানুষের কাছে তিনি একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ।

এখানে ছোট-বড় প্রায় ১৭ টি হ্যাচারী, ৮০ টি নার্সারী এবং কয়েক হাজার মাছচাষি রয়েছেন। সেই হ্যাচারী মালিক ও মাছচাষিদের অনেকেই স্বীকার করেন দেশে মাছচাষের বিকাশে শফিকুল ইসলামের বড় ধরনের অবদান রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছেন। হ্যাচারী মালিক থেকে শুরু করে অনেক মাছচাষিই শফিকুল ইসলামের পরামর্শ নিয়ে এখন সফল হয়েছেন। পাল্লাপাড়া গ্রামের মাছচাষি তোতা মিয়া জানান, শফিকুল ইসলাম দয়ার সাগর। তাঁর সহযোগীতায় আমার মত অনেকেই মাছচাষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরো পড়ুন:
কাহালুর শফিকুল চাতাল ব্যবসায়ী থেকে দেশসেরা রেনু-পোনা উৎপাদনকারী
আশুলিয়া থেকে শিবগঞ্জের পান ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার

আলহাজ্ব মো. শফিকুল ইসলাম জানান, আমার ইচ্ছে যারা চাকুরী না পেয়ে বেকার বসে আছেন তাদের জন্য কিছু করা। বেকারদের মাছচাষের জন্য সার্বিক সহযোগীতা করে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তবেই আমার জীবনে বড় ধরণের সার্থকতা। বেকার মানুষের তাদের শক্তি থাকলে একদিন মাছচাষ করে আমার মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য অফিসার মাহমুদা খাতুন জানান, শফিকুল ইসলাম কাহালু উপজেলাবাসীর একজন রত্ন। মানুষ হিসেবেও তিনি খুবই ভালো। রেনু-পোনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্রুড মাছের গুণগতমান সব-সময় ঠিক রাখেন। রেপু-পোনার গুণগতমান ভালো হলে মাছের উৎপাদনও ভালো হয়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাছুদুর রহমান জানান, আলহাজ্ব মো. শফিকুল ইসলাম উপজেলাবাসীর দেশের একজন গর্বিত মাছচাষি ও রেনু-পোনা উৎপাদকারী।

সেপ্টেম্বর ১১.২০২১ at ১৭:৩৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মশ/জআ