যে কারণে কর্মস্থলে যোগ দিয়েই বদলি হলেন সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস

নতুন কর্মস্থল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় যোগ দেয়ার পরেই বদলি হয়ে গেছেন সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস। মাঝখানে দুই মাস ছুটি কাটাচ্ছিলেন তিনি। তবে অফিস করেননি একদিনও। শুধু সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্বভার গ্রহণ আর হস্তান্তর করেছেন। আর ওই দুইদিনই তিনি দৌলতপুরে এসেছেন। দুদিনে অফিসে থেকেছেন মাত্র ঘণ্টা দুয়েক। কিন্তু কী কারণে তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েই তড়িঘড়ি করে বদলি হয়ে গেলেন এ নিয়ে এখানকার মানুষের মাঝে কৌতূহলের শেষ নেই। দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়া সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাসের এই চমক সৃষ্টিকারী স্বেচ্ছাবদলির ঘটনায় দুর্নীতিগ্রস্তদের মাঝে স্বস্তি ফিরলেও জমি রেজিস্ট্রি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আরেক ভোগান্তিতে পড়েছেন জমি ক্রেতা-বিক্রেতারা।

স্থানীয়দের মতে, দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত দপ্তরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রারের দপ্তর। তবে স্বপ্না বিশ্বাস ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ নির্বাচিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম এ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সক্ষম হন। কিন্তু দুই বছর না পেরোতেই অফিসটিকে আবারো নতুন করে দুর্নীতি ঘিরে ধরে। এমপির নির্দেশ অমান্য করে দপ্তর সংশ্লিষ্টরা এবং দলিল লেখকরা বিভিন্ন স্থানে সাহায্য সহযোগিতাসহ নানা অজুহাতে জমি রেজিস্ট্রি করতে লোকজনের কাছ থেকে পুনরায় বাড়তি টাকা আদায় শুরু করেন।

অন্যদিকে দলিল লেখকদের চলতি বছরের লাইসেন্স নবায়নে সরকারি খরচ ২৫০ টাকা (ভ্যাট বাদে) নির্ধারিত থাকলেও একেকজনের (১৩৬ জন) কাছ থেকে এর বাইরে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। সাব-রেজিস্ট্রার বিলকিস আক্তার প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির যোগসাজশে এই লাইসেন্স নবায়নের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই গত ২৯ ডিসেম্বর এখান থেকে চলে যান। এটিই ছিল সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার বিলকিস আক্তারের এখানকার সাড়ে তিন বছরের শেষ মিশন। তাকে জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায় বদলি করা হয়। তবে তিনি নিজের এই দুর্নীতির দায় চাপানোর চেষ্টা করেন নতুন যোগ দেয়া সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাসের ওপর। অথচ এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না স্বপ্না। এ নিয়ে ভোরের কাগজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হলেও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণেই স্বপ্না বিশ্বাসের এখানকার দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখা দেয় বলে অনেকে মনে করছেন।

জানা যায়, টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে বদলি হয়ে সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস গত ১১ জানুয়ারি দৌলতপুর উপজেলায় যোগ দেন। ওইদিন শুধুমাত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করে ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই দৌলতপুর ত্যাগ করেন তিনি। পরে দুই মাসের ছুটি নেন। তিনি লম্বা সময়ের ছুটিতে থাকায় জমি রেজিস্ট্রি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে অবশেষে টানা এক মাস পর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মকসু মিয়াকে দৌলতপুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সপ্তাহে দুইদিন জমি রেজিস্ট্রির কাজ চালিয়ে নেয়া হয়।

এদিকে দুই মাসের ছুটি শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই নিজের বদলির আগাম বার্তা দিয়ে গত ৩ মার্চ দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস এখানকার অফিসে আসেন। ওইদিনই তিনি এখান থেকে রিলিজ নিয়ে তার পরবর্তী কর্মস্থলের উদ্দেশে দৌলতপুর থেকে বিদায় নেন। তিনি টাঙ্গাইলেরই অপর উপজেলা মির্জাপুরে বদলি হয়ে যান। স্বপ্না বিশ্বাস এখানে যোগ দেয়ার প্রথম দিন এক ঘণ্টার মতো অফিসে ছিলেন আবার বিদায়ের দিনেও প্রায় একই সময় এই দপ্তরে অবস্থান করে দৌলতপুর ছেড়েছেন। সেই হিসেবে যোগ দিয়েই বদলি হয়েছেন তিনি।

দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস।

দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয়ার পরেই সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাসের এমন আকস্মিক বদলিতে দুর্নীতিগ্রস্তদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসলেও বর্তমানে জমি রেজিস্ট্রি কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আরেক ভোগান্তির মুখে পড়ছেন জমি ক্রেতা-বিক্রেতারা সবাই। এই নারী সাব-রেজিস্ট্রারের এ রকম তড়িঘড়ি আসা-যাওয়া বা বদলির ঘটনাকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে এখানকার মানুষজনের মাঝে ব্যাপক কৌতূহল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

একাধিক সূত্র মতে, কুমারখালী উপজেলা থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে আসা সাব-রেজিস্ট্রার মকসু মিয়া মাত্র এক মাস এখানে অফিস করলেও তিনিও দুর্নীতির আগ্রাসন চালিয়েছেন। কবলা দলিল রেজিস্ট্রিতে বাড়তি দেড় হাজার টাকা এবং হেবা দলিল রেজিস্ট্রিতে বাড়তি এক হাজার টাকা আদায় করা হয়। রেজিস্ট্রির কাজে অপরিহার্য টিপ সইয়ের ক্ষেত্রেও ১৩০-১৫০ টাকা করে নেয়া হয়। এই দুর্নীতিতে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেন প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার খবর প্রকাশ হওয়ার পরেও কোনো রকম তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস চাইলেও এখানকার এই অফিসটিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন না ভেবেই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বদলির আবেদন করে স্বেচ্ছায় এই চমক সৃষ্টিকারী বদলি আদেশ নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার প্রয়োজনে দৌলতপুর উপজেলায় শুধুমাত্র সাব-রেজিস্ট্রারের তালিকায় নাম ওঠানো স্বপ্না বিশ্বাসের সঙ্গে মঙ্গলবার (৯ মার্চ) বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ প্রসঙ্গে জেলা রেজিস্ট্রার প্রভাকর সাহার সঙ্গে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সাব-রেজিস্ট্রার স্বপ্না বিশ্বাস নিজের শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে ছুটিতে থাকা অবস্থায় বদলির অর্ডার পাস করিয়েছেন। তবে তার বদলির পেছনে দাপ্তরিক কোনো বিষয়াদি আছে বলে মনে হচ্ছে না। জেলা রেজিস্ট্রার প্রভাকর সাহা বলেন, কুমারখালীর সাব-রেজিস্ট্রার মকসু মিয়াকে কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য দৌলতপুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে এই মুহূর্তে তিনিও অসুস্থ থাকায় সেখানে যেতে পারছেন না। ফলে আপাতত দৌলতপুর উপজেলার রেজিস্ট্রি কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও আমরা যত দ্রুত সম্ভব সেখানে নতুন সাব-রেজিস্ট্রার দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

মার্চ ০৯, ২০২১ at২১:২৪:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরএস/এমআরএইস