সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে মিয়ানমার সাধারণ মানুষ

প্রায় দু’সপ্তাহ আগে মিয়ানমারে বেসামরিক সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু সাধারণ জনগণ সামরিক সরকারের পক্ষে নয়। সেনাবাহিনী যেন নির্বাচনে জয়ী হওয়া বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেজন্য প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাজপথে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দ্য ইকোনমিস্ট।

দেশব্যাপী যে বিক্ষোভ চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা দেশটির কমান্ডার ইন চিফের জন্য কঠিনই বটে। চলতি মাসের ১ তারিখে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চি, দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেই দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়। এর কয়েকদিন পরেই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ মানুষ।

সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সারাদিনব্যাপী রাজপথে সাধারণ মানুষ যেমন বিক্ষোভ করেছে, রাতেও তাদের বিক্ষোভ থামেনি। ইয়াঙ্গুনসহ কয়েকটি নগরীর অধিবাসীরা তাদের বাড়ি থেকে রাতেও বিক্ষোভ করেছেন। তারা ‘অমঙ্গল দূর হবে’ শ্লোগান দিয়ে রীতি অনুযায়ী হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। প্রায় প্রতিরাতেই এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে প্রথম জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। তিনি দেশের জনগণ এবং বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে বক্তব্য রাখেন। অনেকেই ওই ভাষণের সময় নিজেদের টেলিভিশনে সেনা প্রধানের মুখে জুতার বাড়ি মেরেছেন। যারা সে সময় হাড়ি-পাতিল বাজিয়ে বিক্ষোভ করেননি বা সেনাপ্রধানকে জুতা মারেননি তারা হয়তো তার সেই ভাষণ শুনতে পেয়েছেন।

তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, সরকারের কোনো নীতিমালায় বদল আসছে না। এক বছর পর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তার নেতৃত্বে এই অন্তবর্তীকালীন সরকার জান্তা সরকারের চেয়ে আলাদা হবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন এই সেনাপ্রধান।

মিয়ানমারে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী প্রায় ৫০ বছর ধরে সরাসরি দেশ শাসন করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলন কঠোরহাতে দমন করেছে। কিন্তু এবার জেনারেল মিন অং হ্লাইং খুব দ্রুতই নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

নতুন একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের কথাও বলেছেন তিনি। জেনারেল হ্লাইং বলেন, ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪৯ বছর ধরে মিয়ানমারে যে সেনাশাসন চলেছে তার অধীনে সবকিছু অনেক আলাদা হবে।

তিনি মিয়ানমারে সত্যিকার ‘সুশৃঙ্খল গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সেনাবাহিনী সম্প্রতি ক্ষমতা গ্রহণের আগে মাঝের প্রায় ১০ বছর দেশটিতে বেসামরিক সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু সে সময়ও বেসামরিক সরকার পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না। সেখানেও কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে সেনাবাহিনী।

জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের আশ্বাস হয়তো কোনো কাজেই আসবে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের হয়তো গা ঢাকা দিতে হতে পারে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন অপর পলিটিক্যাল প্রিজোনার্সের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশটিতে বিক্ষোভ অংশ নেয়ায় প্রায় ২শ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ইয়াঙ্গুনসহ ১৯টি জেলা, বড় শহর এবং রাজধানী নেপিদোর বেশিরভাগ এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচজনের বেশি মানুষের একত্রিত হওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

এছাড়া বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, জল কামান এবং রাবার বুলেট ছুড়েছে পুলিশ। এদিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, মানদালায় প্রায় ২ হাজার বিক্ষোভকারী পুলিশের ওপর ইট এবং বোতল ছুড়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠি নিয়ে হামলা চালিয়েছে। তিন বিক্ষোভকারী রাবার বুলেটের আঘাতে জখম হয়েছেন। নেপিদোতে দুই বিক্ষোভকারীর ওপর গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া মিয়া থোয়ি খিনে নামে এক নারী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।

হঠাৎ করেই দেশজুড়ে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাধারণভাবেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বিষয়ে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসথার জে নাও নামে ২৭ বছর বয়সী এক মানবাধিকার কর্মী বলছেন, শুধু বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই চলবে না বরং জেনারেলদের তৈরি সংবিধান সংশোধনের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সামরিক সরকারকে বিলুপ্ত করতে না পারি তবে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র কখনও তৈরি করা সম্ভব হবে না।