মীম হত্যার আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গৃহবধূ তাসমীম আক্তার মীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছে নিহত মীমের পরিবার। মীম হত্যার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার মানববন্ধন করা হলেও তা আমলে নেয়নি পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, আসামিদের গ্রেপ্তারে দফায় দফায় অভিযান চালানো হয়েছে। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

একমাত্র কন্যা মীমের মৃত্যু শোকে এখনো বিহ্বল তার বাবা স্কুল শিক্ষক মহিবুল আলম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ঘটনার শুরু থেকেই কোনো কিছু সত্য-মিথ্যার বাছ বিচার না করেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেয়েছে দৌলতপুর থানা পুলিশ। তিনি বলেন, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকেলের এই ঘটনায় লিখিত এজাহার নিয়ে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে দৌলতপুর থানায় গেলে সে সময়ের ওসি (তদন্ত) নিশিকান্ত সরকার আমাকে বলেছিলেন, আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, এখানে আমাদের কিছু করার নেই। এই বলে সেই ওসি আমাকে ফিরিয়ে দেন। অথচ মীমের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের সত্য-মিথ্যা তদন্ত করেও দেখেনি পুলিশ।

মহিবুল আলম জানান, দীর্ঘ ১৪দিন ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে যাওয়া মীমের সুরৎহাল রিপোর্টে শাহবাগ থানা পুলিশ নির্যাতনে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ উল্লেখ করে। একইভাবে গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সোহেল মাহমুদ স্বাক্ষরিত ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে নিশ্চিত করা হয়।

কন্যা হারানো ক্যান্সার আক্রান্ত মীমের মা তাজমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, মীমের মৃত্যুর পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানা পুলিশ হত্যা মামলা রেকর্ড করলেও ঘটনার সাড়ে ৪ মাসের মধ্যে মামলার তদন্তে নানাভাবে গড়িমসি করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত মীমের স্বামী এজাজ আহমেদ বাপ্পী এবং শাশুড়ি কোহিনুর বেগমকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। আমি বেঁচে থাকতে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।

তাজমা খাতুন বলেন, বিয়ের পর মাস না পেরোতেই মীম তার স্বামী ও শাশুড়ির আসল চেহারা দেখতে পায়। আমরা বিষয়টি জানার পর মীমকে বলেছিলাম ওখান থেকে চলে আসতে। কিন্তু মীম রাজি হয়নি। একমাত্র মেয়ের সুখের জন্যে বিয়ের পর নগদ টাকাসহ অন্তত ১০ লাখ টাকার উপহার দিয়েছি। অথচ দাবিকৃত মোটরসাইকেলটি দিতে না পারায় সৃষ্ট পারিবারিক কলহের জেরে তারা মীমের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল।

তাজমা খাতুন আরো বলেন, শাশুড়ি কোহিনুর বেগমের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় মীম দেখে ফেলায় এতে আরো একটি নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। তার ওপর নির্যাতনের নতুনমাত্রা যুক্ত হয়। ঘটনার দিন স্বামীর নির্যাতন ও শাশুড়ির অকথ্য ভাষায় আমাদের উদ্দেশে গালাগাল করার জবাবে মীমও তার শাশুড়ির চরিত্র তুলে কথা বলেছিল, যা আমি মোবাইল ফোনে সংযোগে থাকা অবস্থায় শুনতে পাই। এ সময় শাশুড়িও ছেলের সাথে যুক্ত হয়ে মীমের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে গলায় ওড়না পেচিয়ে মীম আত্মহত্যা করেছে বলে চালানোর চেষ্টা করে তারা।

নিহত তাসমীম আক্তার মীমের বাবা-মা ও ছোট ভাই।

দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া এলাকার বাসিন্দা নৌ বাহিনীর সাবেক সদস্য মৃত জিন্নাহ মোল্লার ছেলে স্ত্রী মীম হত্যা মামলার অভিযুক্ত আসামি এজাজ আহমেদ বাপ্পী ও তার মা কোহিনুর বেগম বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) তাদের তারাগুনিয়া হল বাজারের দোতলা বাড়িটি তালাবদ্ধ দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে সেখানে কাউকেই পাওয়া যায়নি। নিহত মীমের বাবা মহিবুল আলম বাদী হয়ে মা-ছেলে দুজনকে আসামি করে দৌলতপুর থানায় মামলাটি করেন। এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এ থানার এসআই অরুণ কুমারকে।

নিহত মীমের মামা এমএম মুন্না দাবি করেন, মীম হত্যা মামলার আসামি এজাজ আহমেদ বাপ্পীকে নিয়মিত ফেসবুকসহ বিভিন্ন স্যোস্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভ থাকতে দেখছি। তার ফোনও মাঝে মধ্যে খোলা পাওয়া যায়, অথচ পুলিশ নাকি তার কোনো সন্ধানই পাচ্ছে না। অবাধ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে পুলিশ আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারছে না এটি আসলে বিশ্বাসযোগ্য না। তিনি বলেন, এখানে তদন্তকারী কর্মকর্তা বা পুলিশের ব্যক্তিগত কোনো ইন্টারেস্ট আছে। তা না হলে আসামিদের গ্রেপ্তারে এমনটি হওয়ার কথা নয়।

মানবাধিকার কর্মী তাজনিহার বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, গৃহবধু মীম হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকেই পুলিশের নানা অবহেলা ও গড়িমসির অভিযোগ করে আসছে তার পরিবার। এই হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও এর কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। না তদন্ত কাজের শেষ, না জড়িতদের গ্রেপ্তার। এই সময়ক্ষেপণই আমাদের প্রমাণ দিচ্ছে এ ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির সত্যতা আছে। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে মীম হত্যার প্রতিবাদ ও ন্যায় বিচারের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না। অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ চার্জশীট দেয়ার দাবি করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দৌলতপুর থানার এসআই অরুণ কুমার জানান, মামলার দুই আসামিকে (ছেলে ও মা) গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় দুই দফা এবং চট্টগ্রামে এক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। আসামি গ্রেপ্তারে বিলম্ব হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই নিহতের পরিবারে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই ক্ষোভের জায়গা থেকেই তারা পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনেছেন। তবে আসামিদের না গ্রেপ্তার করা পর্যন্ত আদালতে চার্জশীট দেয়া যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চার্জশীট দেয়া হবে। যত দ্রুততম সময়ে সম্ভব তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সেই লক্ষে এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।

দৌলতপুর থানার ওসি (তদন্ত) সাহাদাৎ হোসেনও এ ব্যাপারে প্রায় একই তথ্য জানিয়ে বলেন, মীম হত্যা মামলার সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। এটি যেহেতু মার্ডার, তাই আসামি ধরার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আসামিদের কাছ থেকেও আমাদের জানতে হবে কেন, কীভাবে তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সে কারণে চার্জশীট দিতেও একটু বিলম্ব হচ্ছে। সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েও তাদের অবস্থান শনাক্ত করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে খুব শিগগিরই আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং পুলিশের বিরুদ্ধে আনা গাফিলতির অভিযোগ সঠিক নয়।

উল্লেখ্য, দৌলতপুর উপজেলার পাশের উপজেলা মিরপুরের ছাতিয়ান ইউনিয়নের কচুয়াদহ গ্রামের স্কুল শিক্ষক মহিবুল আলমের মেয়ে তাসমীম আক্তার মীম অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে পরিবারের অমতেই নিজের পছন্দে এজাজ আহমেদ বাপ্পীকে বিয়ে করেছিলেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। কিন্তু তার আগেই ঘাতক স্বামী ও শাশুড়ির নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালেই জীবনের পরীক্ষায় হেরে যান মীম।