পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানার লোকসান পোষাতে ইটের দাম বৃদ্ধি

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় সরকারি নীতিমালা অমান্য করে অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানোর ঘটনায় সম্প্রতি চালানো দুই দফা অভিযানে এখানকার ১৪টি ইটভাটায় বিপুল অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়। এই জরিমানার লোকসান পোষাতে ইটভাটা মালিকরা ইটের দাম বৃদ্ধি করেছেন। প্রতি এক হাজার ইটে ৫০০ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা।

ঢাকা থেকে আসা পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট টিমের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু হাসানের নেতৃত্বে গত ২০ জানুয়ারি দিনভর দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানে সঙ্গে ছিলেন, র‌্যাব-১২ কুষ্টিয়া ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর গাফফরুজ্জামান ও পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের সহকারী পরিচালক কমল কুমার বর্মণ। অভিযানে পর্যাপ্তসংখ্যক র‌্যাব সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকা এবং সরকারি নিয়মবহির্ভূতভাবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর দায়ে ওইদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১১টি ইটভাটায় অভিযান চালান কর্মকর্তারা। অভিযানে এসব ইটভাটা মালিককে ৬৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সময়মতো ইটভাটায় উপস্থিত না হওয়া এবং জরিমানার অর্থ দিতে গড়িমসি করার কারণে কর্মকর্তাদের নির্দেশে কয়েকটি ইটভাটার কিছু অংশ গুড়িয়ে দেয়া হয়। এর একদিন আগে গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম দফার অভিযানে এখানকার তিন ইটভাটা মালিককে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দুই দফার অভিযানে মোট ৮০ লাখ টাকা জরিমানা দেন ইটভাটা মালিকরা।

বিপুল অঙ্কের এই জরিমানার টাকা পরিশোধ করার পর এখানকার ইটভাটা মালিকরা তাদের লোকসান পুষিয়ে নিতে ইটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। অভিযানের আগে তারা প্রতি হাজার ইট সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে আসলেও জরিমানার পর সেই ইটের দাম ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বর্ধিত মূল্যেই বর্তমানে ইট বিক্রি করছেন ভাটা মালিকরা।

এদিকে অভিযানের পর গত ২৪ জানুয়ারি বিকেলে উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতি জরুরি মিটিং করে। ওই মিটিংয়ে এক পক্ষ (জরিমানা দেয়া ভাটা মালিকরা) সমিতির ফান্ড থেকে জরিমানার সব অর্থ পরিশোধের দাবি করেন। আর অপর পক্ষ দাবি করেন, যাদের ভাটায় জরিমানা করা হবে তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে জরিমানার টাকা পরিশোধ করবেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ভাটা মালিকরা একে অপরের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে শেষমেষ তাদের ওই মিটিংই পণ্ড হয়ে যায়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের মধ্যস্থতায় মালিক সমিতির সভাপতি রমজান আলীকে নিরাপদে সরিয়ে আনার পথে (সেন্টার মোড়ে) তার ওপর হামলা চালানো হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের পরেও প্রতিদিন ইটভাটাগুলোয় এভাবেই ট্রাক থেকে কাঠ নামানো হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে ৬ লাখ টাকা জরিমানা দেয়া উপজেলা পরিষদের পাশের এলাকা স্বরুপপুরের এবিসি ব্রিকসের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক ইটের দাম বৃদ্ধি করার কথা স্বীকার করে জানান, অভিযানের পর ইটের ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হওয়ায় প্রতি হাজার ইটে ৫০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। কিছুটা হলেও লোকসান পোষাতে দাম বাড়ানো ছাড়া আপাতত আর কোনো পথ নেই।

জরিমানার আওতায় না পড়াদের মধ্যে থাকা দৌলতপুর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হাজি রমজান আলী ইটের দাম বাড়ানোর বিষয়ে খানিকটা ঘুরিয়ে বলেন, আমি প্রতি হাজার ইটে ২০০ টাকা করে বাড়িয়েছি। অন্যসব ভাটার মালিকরা কত কী বাড়িয়েছে তা আমার সঠিক জানা নেই। তবে পরিবহন খরচ দিয়ে আমার এখানেও ৫০০ টাকা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি টাকা বাড়তি খরচ পড়ে যাচ্ছে।

অভিযানের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকারি বিধি-বিধান মেনে ইটভাটা চালানোর জন্য ভাটা মালিকদের নির্দেশ দিলেও তা মানছেন না কেউই। অভিযানের পরেও ইটভাটাগুলোয় অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিন স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগার ওপর দিয়ে ট্রাক ট্রাক কাঠের খড়ি ইটভাটাগুলোতে নেয়া হচ্ছে। যশোর ও খুলনা অঞ্চল থেকে এসব কাঠ আনেন ভাটা মালিকরা।

উল্লেখ্য, দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ২৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় সরকারি নিয়মনীতিকে কোনো রকম তোয়াক্কা না করে জ্বালানি হিসেবে কয়লার বদলে অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় ইটভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানোর মচ্ছব চলে আসলেও তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। কিছুদিন আগে উপজেলা প্রশাসন শুধুমাত্র দুটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে নামেমাত্র ৫০ হাজার টাকা করে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। সেই অভিযানকে প্রশাসনের দায়সারা বা আইওয়াশ অভিযান হিসেবে দেখছেন এখানকার সচেতন লোকজন। স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতার বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর বের হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এখানে পরপর দুটি অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানমুক্ত রয়েছে এখনো ১২টি ইটভাটা। বাকি ভাটাগুলোতেও খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানুয়ারী, ২৮, ২০২১ at ২১:৫৫:২৫ (GMT+06)
দেশদর্পণ/এমটি।/এসআরএস/এমআরএইস