মন্ত্রীর কথায় অসঙ্গতি, প্রতারক সাহেদের দুর্গতি!

করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগ সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে মানুষকে। আর সরকারকে ফেলেছে নানান প্রশ্নের মুখে। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাত নিয়ে সরকার বিব্রত বা অস্বস্তিতে পড়েছে কিনা তা সুনির্দিষ্টভাবে জানার সুযোগ আমাদের নেই। তবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এটা নিঃশঙ্কচে বলে দেয়া যায়। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সরকারের কঠোরতাকে খুব একটা আমলে নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।

রিজেন্টকাণ্ডে এই মুহূর্তে ম্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি সামনে চলে আসায় সঙ্গত কারণেই বিদ্যুতের বিল কেলেঙ্কারির ঘটনা আড়ালে পড়ে গেছে। রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার বিশিষ্ট প্রতারক সাহেদই গোটা দেশজুড়ে এখন আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তিনি যথারীতি গণমাধ্যমের কাছেও হট কেক। সাহেদ যেসব টিভিতে টকশোর তালিকাভুক্ত অতিথি হয়ে স্টুডিওর মেকাপটেকাপ নিয়ে এতদিন নীতিকথা বলে এসেছেন এখন সেই সব টিভিকেই তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর প্রচার করতে হচ্ছে পাল্লা দিয়ে।

রিজেন্টের দুটি হাসপাতালকে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য অবৈধপন্থায় সরকারিভাবে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছিল। রিজেন্টের লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকা সত্ত্বেও তাদের কোভিড চিকিৎসার অনুমোদন দেয়া হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেন। কোভিডের ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে টিভি টকশোর পরিচিত মুখ রিজেন্ট গ্রুপের প্রতারক চেয়ারম্যান সাহেদের আসল চেহারা। বন্ধ করে দেয়া হয় রিজেন্টের সকল কার্যক্রম। এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে সাহেদের অজানা সব কুকর্মের কথা। গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দেন সাহেদ।

এর মাঝেই করোনা পরীক্ষার আরেক জালিয়াতি প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে নতুন করে হইচই শুরু হয়। ঝড় ওঠে গণমাধ্যমে। ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। দুদিন পর সেই ঝড় থেমে যায়।

রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে চুক্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিফতরের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত থাকলেও তিনি ওই চুক্তির বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে গণমাধ্যমে দাবি করেন। মস্ত্রীর এই অসঙ্গতিপূর্ণ কথায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিনোদনের খোরাক তৈরি হয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে শোকজ করে নিয়মবহির্ভূতভাবে হওয়া ওই চুক্তির ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জবাবে দায় চাপিয়ে দেন সাবেক স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলামের ওপর। এর আগেই গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হয়ে যায়। দেশের মানুষের কারো জানতে বাকি থাকে না স্বাস্থ্যখাতের উলঙ্গতার কথা।

এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার (১৫ জুলাই) ভোরে গ্রেফতার করা হয় বহুল আলোচিত দেশের শীর্ষ প্রতারক সাহেদকে। যদিও সাহেদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। সাহেদ গ্রেফতারের পর তার কোমরে থাকা পিস্তলসহ ছবি তোলার বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। ওইদিন বিকালে র‌্যাব সদর দফতরে ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব প্রধান এ কথা জানান।

তবে যে প্রক্রিয়াতেই হোক তাকে ধরা গেছে এটাই যথেষ্ট। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কী লাভ?। এখন তার প্রভাবদাতাদের আইনের আওতায় আনার দাবি সব মহলের। যদিও টেন্ডার কিং জিকে শামীম, ক্যাসিনো সম্রাট ইসমাইল চৌধুরী, ওয়েস্টিন কুইন পাপিয়াসহ সবার ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকরা সব সময় আড়ালেই থেকে গেছেন। ফলে সাহেদের পৃষ্ঠপোষকদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। তবুও এসব প্রভাবদাতাদের আইনের মুখোমুখি আনার দাবি থাকবেই।

রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বুধবার (১৫ জুলাই) নিজ অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। তিনি সচিবালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নানের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা জমা দেন। সেখানে তিনি বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল সাবেক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের মৌখিক নির্দেশে। তবে সাবেক এই সচিব একই দিন গণমাধ্যমে এ বিষয়টি অস্বীকার করেন।

স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তির লিখিত আদেশ এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে কিনা। মহাপরিচালক জানিয়েছেন, সেই চুক্তি করা হয়েছিল সাবেক স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলামের মৌখিক নির্দেশে। যিনি বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

কী একটা ভজঘট অবস্থা। মৌখিক নির্দেশে এতবড় একটা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন হয় নাকি?। ডিজির এই ব্যাখ্যার বিষয়টি নিছক গোঁজামিলমার্কা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করা হচ্ছে। এত গেল ডিজির গা বাঁচানো ব্যাখ্যা কাহিনী। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তো চুক্তির ব্যাপারে জানতেন না বলে আগেই এ থেকে দায়মুক্তি নিয়ে ফেলেছেন। এ ধরনের স্পর্শকাতর ঘটনায় চুক্তিকে কেন্দ্র করে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যই প্রমাণ করে তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই ঘাপলা আছে। এভাবে ঠেলাঠেলি করে তারা কেউই এর দায় এড়াতে পারেন না। দেশের স্বাস্থ্যখাতের বেশুমার দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে বহুবার এসেছে। করোনাকালে এই সেবাখাতের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে গেছে। এখন আর ঢেকে রাখার কোনো উপায় নেই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) আদালতে রিমান্ড শুনানির সময় সাহেদ মন্ত্রণালয়ের বিপক্ষেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাহেদ আদালতকে বলেন, ‘আমি মার্চে প্রথম দিন যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাই, তখন তারা আমাকে আমার হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করতে বলেন। তখন আমি বলি আমার লাইসেন্সের ঘাটতি আছে। তখন তারা বলে যে, লাইসেন্স নবায়নের জন্য সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দেন। আমি তাদের কথা মতো টাকা জমা দেই।’

মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আপনার মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মধ্যে নিজেদের গা বাঁচানো নিয়ে টানাপোড়েনের ঘটনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গোঁজামিলমার্কা কথাবার্তা বলে মানুষকে আর হাসাবেন না। করোনা নিয়ে মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছেন দিন, কিন্তু এত বেশি বিনোদন মানুষ যে নিতে পারছে না। আপনাদের (মন্ত্রণালয়, অধিদফতর) এসব তামাশাপূর্ণ ছলচাতুরিপনা ভালোভাবে গ্রহণ করছে না কেউ। তারচেয়ে বরং ব্যর্থতার দায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব থেকে নিজে পদত্যাগ করুন, মহাপরিচালককেও সরিয়ে দিন, মানুষ খুব খুশি হবে। কিছুটা হলেও মানুষের স্বস্তি মিলবে।

পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখা গেছে আইনের খাঁচায় বন্দী ডা. সাবরিনা-আরিফ দম্পতির মধ্যেও। জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক (বরখাস্ত) ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী (প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী) আরিফ চৌধুরী রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে এই অপকর্মের জন্য তারা একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। ডা. সাবরিনা দাবি করেছেন, জেকেজি ও ওভাল গ্রুপের অনেকেই এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। আরিফ চৌধুরীর এই কর্মকাণ্ড এবং ব্যক্তিগত হয়রানির কারণে তিনি তাকে ডিভোর্সও দিয়েছেন। তবে ডা. আরিফ বলেছেন, সাবরিনার কারণেই এই অপকর্মে জড়িয়েছেন তিনি।

করোনার মহামারিতে বিপর্যস্ত সারা দুনিয়া। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। নানামুখী সংকট, দুর্ভোগ-দুর্দশায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে অব্যাহতভাবে। প্রতিনিয়ত বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হচ্ছে। কোথাও মিলছে না স্বস্তির খবর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার থাবা থেকে সহসাই মুক্তির পথ দেখা যাচ্ছে না, নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। এর কার্যকর প্রতিষেধক কবে নাগাদ বের হবে তারও ঠিক নাই।

বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ বাড়ায় আবারো আরোপ করা হচ্ছে বিধি-নিষেধ। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে করোনা ভাইরাস। সপ্তাহখানিক আগে বিভিন্ন দেশে আক্রান্তের হার কিছুটা কমতে শুরু করলেও সম্প্রতি দেশে দেশে সংক্রমণের হার আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে। বিশ্বজুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দুই লাখ ৩৪ হাজার মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যা সংক্রমণের নতুন রেকর্ড। ভাইরাসে ৬ হাজারের বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক জরিপকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে করোনায় এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৮২০ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৬ লাখ ৯১ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে এরই মধ্যে ৮০ লাখ ৩৭ হাজার ১৪০ জন করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন।

করোনা প্রতিরোধে এখনো অনেক দেশ ভুল পথে হাঁটছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আডানম গেব্রিয়েসাস। সহসাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেছেন, মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে, অবস্থার আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের দায়িত্বহীনতাকে দুষছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অন্যদিকে এই দুঃসংবাদের মাঝে জাতিসংঘ দিয়েছে আরেক দুঃসংবাদ। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, দীর্ঘমেয়াদী করোনার প্রভাবে বিশ্বে ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ নতুন করে চরম খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে বিশ্বজুড়ে মোট দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ২৬ কোটি। অর্থাৎ করোনার ছোঁবল ছাড়াও বহু মানুষ না খেয়ে মারা যাবার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

করোনার এমন ভয়াবহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বাইরে নয় ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশও। সংক্রমণের শুরু থেকেই এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নানা অসঙ্গতি বিদ্যমান। একই সঙ্গে টাকা কামানোর মেশিন হিসাবে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে আশির্বাদ হয়ে আসে এই করোনা। করোনাকে মোক্ষম সুযোগ হিসাবে লুফে নিয়ে স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি চলে আসছে। যা এখন আর গোপন নাই। সবারই জানা।

লোভেরও একটা সীমা থাকা উচিত। ক্ষমতা হাতের মুঠোয়, তাই বলে টাকার লোভে দেশের সংকটময় মুহূর্তেও মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে হবে?। যারা এসব নিষ্ঠুর নির্মমতায় লিপ্ত হয়েছেন তারা কখনো মানুষ হতে পারেন না, মানুষরূপী অন্যকিছু। মানুষের এতটা নৈতিক স্খলন হতে পারে ভাবাও যায় না। করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দুই নম্বরি নিয়ে বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হলেও এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারো মধ্যে তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।

সীমা লঙ্ঘনের পরিসমাপ্তিও আবার সুখকর হয় না। যা ইতোমধ্যে আমরা পুরোটা নয়, খানিকটা দেখতে পেয়েছি। গত রোববার (১২ জুলাই) করোনা পরীক্ষা নিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণার মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর তিন দিনের মাথায় বুধবার (১৫ জুলাই) আরেক মোস্টওয়ান্টেড রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান বহুমুখী প্রতারক মো. সাহেদকে নানা নাটকীয়তায় গ্রেফতার করে র‍্যাব। এর মধ্য দিয়ে আলোচনার মোড় ঘুরে যায় অন্য দিকে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে গ্রেফতার সাহেদকে রেপ্লিকা সাহেদ বলে যে দাবি তোলা হয়েছে সেটা পুরোপুরি অযৌক্তিক। অবৈধভাবে গড়ে তোলা বিশাল দুর্গের অধিপতি প্রতারক সাহেদের এখন চরম দুর্গতি। এতকিছুর পরেও তাকে ছয় মাসের বেশি আটকে রাখা যাবে না বলে দম্ভোক্তি করেছেন তিনি।

এই দুঃসময়ে দেশে চিকিৎসার বেহাল ব্যবস্থা আর স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি বলে দেয় আমরা কোন পথে হেঁটে আসছি। এ অবস্থায় প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা আইইডিসিআর দেখাচ্ছে তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আইইডিসিআরের রোজনামতার বাইরেও পরীক্ষাহীন আক্রান্তের সংখ্যা এবং উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলেই অনেকে ধারণা করছেন। সার্বিকভাবে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশেও করোনার অারো ভয়াবহ রূপ অপেক্ষা করছে। যা হয়তো কাগজ-কলমের হিসাবে আড়াল করা যাবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা দেবে ভিন্ন চিত্র। প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকার দিকে তাকালেই এর একটা চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

অন্যদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা উপেক্ষা করে যখন ত্রাণের চাল চুরি হয়, প্রধানমন্ত্রীর নগদ টাকা উপহারের তালিকায় গরিব অসহায়দের জায়গায় যখন স্বচ্ছলদের নাম ওঠে, নানান অনিয়ম, অসঙ্গতির কারণে রোজার ঈদের বরাদ্দ করা টাকা কোরবানির ঈদে বিতরণের উদ্যোগ নিতে দেখা যায় তখনো আমাদের নৈতিক স্খলন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যতই খাদ্যসশ্য উৎপাদনে সক্ষমতা থাকুক এই নৈতিক স্খলনের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে স্বাস্থ্য সংকটের মতো খাদ্য সংকটও দূর করা সম্ভব নয় বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাহেদের সাথে কারা কারা ছিলেন, সরকারের কোন কোন মন্ত্রী, কোন কোন রাজনীতিবিদ, কোন কোন আমলা, কোন কোন সাংবাদিক, আর কোন পেশার কোন মানুষ সবাইকে খুঁজে বের করা জরুরি। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে কারা তাকে দাওয়াত দিতেন, কারা তাকে ভারত অব্দি পৌঁছে দিয়েছেন এগুলো খুঁজে বের করার যৌক্তিক দাবি উঠেছে। বলা হচ্ছে, অসংখ্য ঘটনার দরকার নেই, এক সাহেদের আদ্যপান্ত তদন্ত করলেই পুরো রাষ্ট্রের চিত্র বেরিয়ে আসবে।

জালিয়াতি চক্রকে গ্রেফতারের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই আমরা পুরোপুরি ধন্যবাদ দিতে পারছি না। সাবরিনা, সাহেদেরা যাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে এতবড় দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন সেই প্রভাবদাতাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হলে কেবল তখনই শুধু ধন্যবাদ নয়, সাথে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাবো আমরা।

লেখক : এস আর সেলিম, সংবাদকর্মী।