বিদ্যুৎ বিভাগের জিম্মিদশা থেকে গ্রাহকের মুক্তি কবে?

বিদ্যুতের মনগড়া বিলের খপ্পরে পড়েননি এমন কোনো গ্রাহক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সারাদেশের গ্রাহকই পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতার কাছে। করোনাকালে তাদের মনগড়া বিলের কারসাজিতে সবাই জিম্মি হয়ে পড়লেও কারোরই কিছু করার থাকছে না। মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রাহকেরা সবাই। গ্রাম থেকে শহরে সব গ্রাহকেরই এবার একই অবস্থা। করোনার এই দুঃসময়ে কাঁধের ওপর চাপিয়ে দেয়া বাড়তি বিলের বোঝা নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেক গ্রাহককে। দ্বিগুণ, তিনগুণ বিল কষা হলেও এর কোনো প্রতিকার মিলছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনগড়া বিল কষার বিষয়টি কবুল করেছেন। বলেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে মিটার রিডাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রিডিং নিতে পারেননি তাই আগের বিলগুলো পর্যালোচনা করে এপ্রিলে গড় বিল করা হয়েছে। কারো কাছে বাড়তি বিল চলে গেলে পরবর্তীতে তা সমন্বয় করে দেয়া হবে। যা অফিসে গিয়েও করা যাবে, আবার অফিসে না গেলেও চলবে। বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বেই বাড়তি বিল পর্যালোচনা করে সমন্বয় করে দেবেন। ভালো কথা, ওই পর্যন্ত ঠিক ছিল যদি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সত্যিকার অর্থেই গ্রাহকদের বাড়তি বিলের বোঝা সমন্বয় করে দিতেন। কিন্তু; বাস্তব চিত্র পুরোই ভিন্ন।

করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি উপেক্ষা করে গ্রাহকরা গায়ে গা ঘেঁষে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ বিল সমন্বয় করতে গেছেন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে। কেউ কেউ তাদের বিল নামেমাত্র সমন্বয় করে নিতে সক্ষম হলেও বেশির ভাগ গ্রাহকই সেই সুযোগ পাননি, সোজা করে বললে তাদের বিল সমন্বয় করা হয়নি। বরং পরের মাসেও (জুন) প্রায় একইভাবে বাড়তি বিল কষা হয়েছে। আগের বাড়তি বিল কেন সমন্বয় করা হয়নি, উপরোন্ত নতুন বিলেও কেন বাড়তি টাকার বোঝা চাপানো হয়েছে তা হয়তো সবার জানা নাই। করোনাকে ব্যবহার বা ইস্যু করে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই বাড়তি বিলের আয়োজন করা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

অনুসন্ধান বলছে, বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে একের পর এক বাড়তি বিলের বোঝা গ্রাহকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। নির্বিঘ্নভাবে তাদের অনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করছেন। তারা ভালো করেই জানেন, এ ধরনের মনগড়া বিল নিয়ে গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হবেন ঠিকই কিন্তু; একই সঙ্গে মেনে নিতেও বাধ্য হবেন। এর কোনো গত্যন্তর নাই। কেননা, সত্যিই বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রাহকরা পুরোপুরি জিম্মি এটা তারা বুঝে গেছেন। ফলে সাময়িক ক্ষুব্ধ হয়ে দূর থেকে গালাগাল করলেও কিছুই করার থাকবে না গ্রাহকদের। সুতরাং আইওয়াশ করতে কয়েকজনের বিল সমন্বয় করে দিলেই কেল্লাফতে, বাকি সবগুলো ‘হালাল’ হয়ে যাবে। বলা দরকার, মানুষের রক্ত চুষে খাওয়াদের কাছে মানুষের গালাগাল খাওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। ওই অদুশ্য গালাগাল হজম করার বিনিময়ে ইচ্ছামতো রক্ত চুষে খাওয়া যাচ্ছে আর কী লাগে!

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়তি বিলের এই মিশন সাকসেস করে চলেছেন। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, ইতোপূর্বেও প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের যাবতীয় মিশন সাকসেসফুল হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশে এই একটা সেক্টরই আছে যার কোনো জবাবদিহীতার বালাই নাই। জবাবদিহীতা নাই এমন অারো কিছু সেক্টর থাকলেও সেসব নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা নাই। সাধারণ গ্রাহকদের জিম্মি করে যাচ্ছেতাই করা যাবে অথচ কেউ টুশব্ধও করবে না, এটাই বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিজের বিলের হিসাবটা দেই, এপ্রিলের সেই আলোচিত গড় বিল এসেছিল ১ হাজার ৭৫২ টাকা। যা আগের মাসের দ্বিগুণ। পরে মে মাসের বিল এসেছে ৮৪২ টাকা। এটা স্বাভাবিক বিল হলেও কর্তৃপক্ষ বলছেন, এখানে এপ্রিলের বিল সমন্বয় করা হয়েছে। সমন্বয়ই যদি হবে সেক্ষেত্রে মে মাসে তো বিলই থাকার কথা নয়। মিনিমাম বিল বলতে যেটা বোঝানো হয় সেটাই আসার কথা। আচ্ছা ঠিক অাছে তবু মেনে নিলাম সেটা সমন্বয় করা হয়েছে, কিন্তু; জুন মাসের বিল আবার ১ হাজার ৪৬৯ টাকায় লাফিয়ে উঠল কেন?। বিদ্যুতের ব্যবহার তো আগের মতোই ছিল, তাহলে এখন কী বলবেন?।

বাড়তি বিল সমন্বয়ের যে কথাটি বলা হয়েছে তা কখনোই হবে না। যেটা হবে সেটা হচ্ছে জাস্ট আইওয়াশ। যেভাবেই সমন্বয় করা হোক, যখনই করা হোক এই সমন্বয়ের নামে প্রতিটি বিলের বিপরীতে গ্রাহককে কমবেশি অতিরিক্ত টাকা গুণতেই হবে এর কোনো বিকল্প নাই। ধারণানির্ভর একটা সাধারণ হিসাব দেখা যাক- ধরে নেই, গড়ে কমপক্ষে ২০০ টাকা করে একেকজন গ্রাহককে বাড়তি গুণতে হচ্ছে। সেই হিসাবে একটি মফস্বল এলাকায় ২ লাখ গ্রাহক থাকলে বাড়তি ওই ২০০ টাকা করে যুক্ত করলে মোট বাড়তি টাকা দাঁড়ায় ৪ কোটি টাকা। এবার আসেন পরের মাস গ্যাপ দিয়ে জুনে আবার বাড়তি বিলের দিকে। এটাকে যথারীতি বলা হচ্ছে, জুন ক্লোজিংয়ের কারণে সবার বিলই কিছুটা বেশি হয়েছে। যে কারণেই হোক বেশি তো বেশিই। আগেরটা নামেমাত্র সমন্বয় হলেও এই বিলটি সমন্বয়ের কোনো সুযোগই থাকবে না। সুতরাং এখান থেকে বাড়তি টাকার পরিমাণ আরো বেশি দাঁড়াবে। এবার সারাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখেন স্পষ্ট দুই নম্বরির আশ্রয় নিয়ে মোট কত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের মাসগুলোর ঘাটতি কমাতে জুন ক্লোজিংয়ের এই মাসে প্রত্যেকেরই কিছুটা বাড়তি বিল যোগ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ঘাটতিটা কীসের?। যারা নিয়ম করে গ্রাহকের রক্ত চুষে আসছেন তাদের তো বিন্দুমাত্র ঘাটতি কিংবা লোকসান থাকার কথা নয়। আর যদি তা থাকেও তাহলে সেটা গ্রাহকের কাঁধের ওপর চাপাতে হবে কেন?। তথাকথিত ঘাটতি, ক্ষতি বা লোকসান পোষানোর নামে বিদ্যুৎ বিভাগ জনগণের ওপর আর কত জুলুম চালাবে?। একদিকে করোনার ধাক্কা অারেকদিকে বিদ্যুতের ভৌতিক বিলের বিড়ম্বনা। সাধারণ মানুষের কাছে এই বাড়তি বিলের হাতছানি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের জিম্মিদশা থেকে সাধারণ গ্রাহকের মুক্তি মিলবে কবে তা বলার সাধ্য নাই কারো।

গ্রাহকদের সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেয়ার কিংবা তাদের এই নীরবতাকে পুঁজি করে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ দারুণভাবে এটা কাজে লাগাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কী গ্রাহকরা বিদ্যুতের লোকজনের সঙ্গে মারামারি করবে?। না, মারামারি করতে হবে না। তাতে জটিলতা আরো বাড়বে। আরো নাজেহাল হতে হবে। মামলা-মোকাদ্দমায় পড়তে হবে। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারীতার বিপক্ষে গ্রাহকদের একাট্টা হয়ে সমস্বরে প্রতিবাদ জানাতে হবে। প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা গেলে চাপের মুখে পড়ে একটা সময় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের রক্ত চোষার এই মনোবৃত্তি থেকে হয়তো সরে আসতে বাধ্য হবেন।

বলা হয়েছিল- মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন এই চার মাসের বিদ্যুৎ বিল বিলম্ব মাশুল ছাড়াই পরিশোধ করা যাবে। তবে ব্যাপাটা আসলে এ রকম যে, ‘কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই।’ বিলম্ব মাশুল দিয়েই বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। মনগড়া বাড়তি বিল সমন্বয়ের বিষয়টাও ঠিক এই রকমই। বিদ্যুৎ বিভাগ নিজেরা কখনো গ্রাহকদের জন্য ভর্তুকি দিয়েছে এমন কোনো নজির নাই। বরং তাদের তথাকথিত লোকসান পোষাতে জিম্মি হয়ে পড়া সাধারণ গ্রাহকদেরই বেছে নেয়া হয় বারবার।

গণমাধ্যমে এসেছে, আগামী ৭ দিনের মধ্যে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বিভাগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এ জন্য নাকি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তকেও আইওয়াশের অংশ হিসাবেই দেখছেন অনেকে। সিস্টেমের বাইরে নিজস্ব সিস্টেমে চলা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর এই অপরাধের বিচার হবে, এটা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কর্তাব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়া অধিনস্তরা কখনোই এভাবে মনগড়া বিল বানানোর সাহস রাখেন না বলেও মনে করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে অনেকে মন্তব্য করছেন, করোনার কয়েক মাসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে গেছে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে তা বিক্রি না হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ লোকসানের মুখে পড়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই গ্রাহকদের পকেট কাটতে ভুতুড়ে বিল তৈরি করা হয়েছে।

পাওয়ার সেলের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিদ্যুৎ খাত চতুর্মুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও বিল আদায় সব দিকেই ক্ষতির মুখে বিদ্যুৎ খাত। পাওয়ার সেলের হিসাব অনুযায়ী করোনার কারণে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ভর্তুকি বাড়বে।

মিটার রিডাররা অনুমাননির্ভর হয়ে বিল করার কারণেই ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের সৃষ্টি হয়েছে- বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তরা গণমাধ্যমের কাছে এমন দাবি করলেও আসল কারণ ভিন্ন বলে মনে করেন সাধারণ গ্রাহকরা। করোনাকালের ক্ষতি পোষাতেই পরিকল্পিতভাবে লাগামছাড়া বিল চাপিয়ে দেয়া দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর এমন দায়িত্বহীন আচরণের কারণেই সরকারকে কঠিন সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছে। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে গ্রাহকের ভোগান্তি বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক বিল সমন্বয় করার ঘোষণার পরও অনেক গ্রাহকেরই বিল সমন্বয় করা হয়নি। আবার কোনো কোনো এলাকায় ভুতুড়ে বিল কমিয়ে দেয়ার কথা বলে মিটার রিডাররা দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন বলেও গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব যথার্থই মূল্যায়ন করেছে। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এভাবে বিল করা বাঞ্ছনীয় নয়। এই দুর্যোগে মানুষের সঙ্গে এ ধরনের তামাশা করা ঠিক হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের দুর্নীতি বন্ধ করছে না। অথচ ভোক্তাদের কাঁধে ভর করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের মনগড়া বিলের কবলে পড়েছেন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ। সারাদেশে বিদ্যুৎ বিলের এমন দূরাবস্থার বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমেও বেশ হইচই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হঠাৎ এই ভুতুড়ে বিলের কারণে অনেক গ্রাহক এখন পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে পারেননি। রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর কর্মকর্তারাও ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড (আরইবি), ওয়েস্টজোন পাওয়ায় ডিস্টিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমের কাছে ভুতুড়ে বিলের সত্যতা স্বীকার করে সমন্বয়ের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও সঙ্গত কারণেই বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতি মানুষের অাস্থার সংকট প্রবল অাকার ধারণ করেছে।

লেখক : এস আর সেলিম, সংবাদকর্মী।